অন্য দেশের নির্বাচন বিষয়ে মন্তব্য করবে না যুক্তরাষ্ট্র

বিদেশি কোনো দেশের নির্বাচনের ব্যাপারে এখন থেকে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করবে না যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট। বৃহস্পতিবার বিশ্বজুড়ে সব মার্কিন দূতাবাস ও কনস্যুলেটকে পাঠানো এক বার্তায় জানানো হয়েছে, কেবল তখনই মন্তব্য করা হবে যখন নির্বাচনের ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক স্বার্থের সঙ্গে ‘স্পষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ’ভাবে সম্পর্কিত হবে।
প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির আওতায় এই নির্দেশনা জারি করা হয়েছে, যার মূল লক্ষ্য বিদেশি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে সম্মান জানানো। স্টেট ডিপার্টমেন্টের বার্তায় বলা হয়েছে, প্রশাসনের সার্বভৌমত্বকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এখন থেকে নির্বাচনী বিষয়ে কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত কোনো ইস্যু থাকলেই মন্তব্য করা হবে।
দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের সমালোচনায় সরব থেকেছে। তবে নতুন নীতিতে এসব বিবৃতি সংক্ষিপ্ত, নিরপেক্ষ এবং কেবল বিজয়ী প্রার্থীর প্রতি অভিনন্দন বার্তা ও পারস্পরিক স্বার্থের ইঙ্গিতে সীমাবদ্ধ থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সেক্রেটারি অব স্টেট মার্কো রুবিওর স্বাক্ষরিত চিঠির ভিত্তিতে প্রথম খবরটি প্রকাশ করে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। সেখানে বলা হয়েছে, কোনো দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া, বৈধতা বা গণতান্ত্রিক মান নিয়ে আর কোনো মন্তব্য করা যাবে না।
ফলে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসগুলো আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা—অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড কোঅপারেশন ইন ইউরোপ, কার্টার সেন্টার, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট কিংবা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট-এর প্রতিবেদন অনুসারে কোনো ধরনের নির্বাচনী অনিয়ম নিয়ে মন্তব্য করতে পারবে না, যদি না ওয়াশিংটনের শীর্ষ মহল থেকে সরাসরি অনুমোদন আসে।
এই পরিবর্তন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে আরও কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে এবং দীর্ঘদিন ধরে গণতন্ত্র ও সুশাসনের পক্ষে অবস্থান নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান থেকে সরে আসার প্রতিফলন বলে বিশ্লেষিত হচ্ছে।
মানবাধিকার সংস্থা ও গণতন্ত্র প্রচারকারী সংগঠনগুলো এই সিদ্ধান্তে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, এই পদক্ষেপ স্বৈরশাসকদের আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে এবং নির্বাচনী স্বচ্ছতা পর্যবেক্ষণে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী নেতৃত্বকে দুর্বল করবে।
এই সিদ্ধান্ত এমন এক সময়ে এলো, যখন ট্রাম্প প্রশাসন একাধিক স্বৈরাচারী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি ক্রমেই আদর্শ থেকে সরে ব্যবসায়িক ও কৌশলগত স্বার্থকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে।
এর আগে গত ১৮ মে স্টেট ডিপার্টমেন্ট ‘মানবাধিকার’ শব্দের সংজ্ঞা পুনর্নির্ধারণ করে। এর মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ও স্বীকৃত মানবাধিকার সংজ্ঞাকে সংকুচিত করা হয়। নতুন নির্দেশনার আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে দুর্বল কারাগার পরিস্থিতি, সরকারি দুর্নীতি, কিংবা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে বাধার মতো বিষয় বাদ পড়েছে।
ফলে শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা, অবাধ নির্বাচনের পথে বাধা, রাজনৈতিক বন্দিদের অধিকার লঙ্ঘনের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র প্রতিবেদনগুলোতে আর প্রতিফলিত হচ্ছে না। এনপিআর-এর হাতে আসা স্টেট ডিপার্টমেন্টের মেমো অনুযায়ী, কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন তারা প্রতিবেদনগুলোকে ‘ন্যূনতম আইনি প্রয়োজনীয়তা’র মধ্যে সীমিত রাখেন।
২০২৪ সালের প্রতিবেদনটি প্রস্তুত হলেও সম্পাদনার কারণে তা ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। প্রতিবেদনে বাদ গেছে বৈচিত্র্য, সমতা ও অন্তর্ভুক্তির প্রসঙ্গ, এলজিবিটিকিউ+ জনগোষ্ঠীর ওপর সহিংসতা ও বৈষম্যের তথ্য, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ওপর সহিংসতা, ইন্টারনেট স্বাধীনতা হ্রাস এবং মানবাধিকার সংস্থার হয়রানির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো।
মানবাধিকার কর্মীরা এই পরিবর্তন নিয়ে তীব্র উদ্বেগ জানিয়েছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক পল ও’ব্রায়েন বলেন, এসব পরিবর্তনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র যেন বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার রক্ষায় তার নেতৃত্বের ভূমিকায় থেকে সরে আসছে।
মানবাধিকার বিষয়ে অবস্থান পরিবর্তনের পর এবার নির্বাচন নিয়ে চুপ থাকার সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের ‘গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের’ ঐতিহ্যবাহী ধারণাকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে।