বিসিএস বিপর্যয় নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে, আশানুরূপ নয় ফলাফল

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ৪৪ তম বিসিএসের ফলাফল যেন এক করুণ বার্তা। ৪৪ তম বিসিএসে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাত্র একজন শিক্ষার্থী সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছে।
গত ৩০ জুন বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) ৪৪তম বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করে। এতে সারাদেশ থেকে ১,৬৯০ জন প্রার্থীকে বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশ করেছে পিএসসি। ফলাফল দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি সময়ে প্রতিষ্ঠিত বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দশ জনের অধিক, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুইজন প্রশাসন ক্যাডারসহ মোট ছয় জন সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছে। সেখানে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের (২০১২-২০১৩) সেশনের মাহবুবা নামের শুধুমাত্র একজন শিক্ষার্থী শিক্ষা ক্যাডারে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়েছে।
বিসিএস এ এমন ভরাডুবি পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, ছাত্রছাত্রীদের প্রস্তুতি ও ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিবেশ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রশ্ন উঠেছে। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর দাবি, শুধু বিসিএস নয় বরং ব্যাংক, সাব-ইন্সপেক্টর'সহ অন্য সকল প্রতিযোগিতামূলক চাকরি পরিক্ষাতেও ধরাশায়ী অবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের। প্রায় সফলতা শূন্য বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য মাস্টার্স কিংবা পিএইচডি প্রোগ্রামে স্কলারশিপ অর্জনেও।
পড়ালেখা শেষে পেশাগত জীবনে কিংবা বিদেশে উচ্চশিক্ষাসহ সকল ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের এমন নাজুক অবস্থা নিয়ে হতাশ ক্যাম্পাসের জুনিয়র শিক্ষার্থীরাও। যা উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাঝেও।
শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন পূরণে বিশ্ববিদ্যালয়টি ব্যর্থ কেন? এর কারণ খুঁজতে সরজমিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী- শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে একাধিক কারণ। যার মধ্যে অন্যতম বিগত ফ্যাসিবাদী সময়ে ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া, শিক্ষার্থী ভর্তি প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি, শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতি।
বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা পেশাগত জীবনে কেন ভাল করতে পারছেন না এমন বিষয় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা শিক্ষার্থী আসলাম বেগ বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা পেশাগত জীবনে ভালো না করার অনেক কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পতিত স্বৈর-শাসনকালে বেশিরভাগ শিক্ষকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সুপারিশ ও রাজনৈতিক পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে। বিশেষ যোগ্যতার নামে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত শিথিল করে মেধাবীদের পরিবর্তে দলীয় অনুগত ও পছন্দের প্রার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যারা পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কার্যক্রমে যুক্ত করার চেয়ে নিজেদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতিতে যুক্ত করেছে, ছাত্র রাজনীতির প্রভাবক ও মেন্টর হিসেবে কাজ করেছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জনি সরকার বলেন, ‘একাডেমিক শিক্ষাক্রমের সাথে প্রতিযোগিতা মূলক চাকরি পরীক্ষার পড়ালেখা যদিও ভিন্ন। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চাকরি পরীক্ষায় যেমন ভালো করতে পারছে না, একইভাবে গবেষণা ও একাডেমিক দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রেও ভালো করতে পারছে না। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালের ছয় বছরে তেমন কোন সিনিয়র ভাই-আপু'কে দেখিনি যে কেউ বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপে পিএইচডি বা এমফিল করতে গিয়েছে। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও উচিৎ এটাকে নিজেদের ব্যর্থতা হিসেবে দেখা এবং এর কারণ অনুসন্ধান করা।’
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করে চাকরি প্রত্যাশী আর এক শিক্ষার্থী তৈয়ব শাহানূর বলেন, ‘বিগত ফ্যাসিবাদী সময়ে যে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি ছিলো তার প্রত্যক্ষ খেসারত গুনতে হচ্ছে বর্তমান চাকরি প্রত্যাশী শিক্ষার্থীদের। ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে একটি সন্ত্রাসী আবহও গড়ে ছিলেন৷ শিক্ষার্থীদের সবসময় ভীতসন্ত্রস্ত করে ক্লাসে পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রোগ্রামে নিয়ে যাওয়া হতো। হলের সিটের বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে দিন-রাত রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ব্যস্ত রাখার বিরূপ প্রভাব এখন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বর্তমান প্রশাসনের উচিৎ বিগত ফ্যাসিবাদী সময়ে সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে পড়ালেখার জন্য একটি সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা।’
ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে লোক প্রশাসন ও সরকার পরিচালনা বিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. অলি উল্লাহ বলেন, ‘শিক্ষকদের মোটিভেশন দেওয়ার অভাব আমি সবচেয়ে বড় কারণ মনে করি। শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার সচেতনতার অভাব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো লাইব্রেরি কালচার না থাকা, শিক্ষার্থীদের ভিশন-মিশন ও ডেডিকেশনের অভাব, লাইব্রেরি ও রিডিং-রুম কালচার ডেভেলপ না হওয়া, শিক্ষার্থীদের কন্টিনিউয়াস এফোর্ট না থাকা, কৌশল প্রণয়নের অভাব এবং মফস্বল এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া অন্যতম কারণ’। তিনি আরও বলেন, ভিসি মহোদয় লাইব্রেরির মান উন্নয়নে এবং শিক্ষার্থীদের মোটিভেট করার জন্য লাইব্রেরিতে এসি লাগানোর বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
শিক্ষার্থীদের এমন ব্যর্থতার কারণ জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরামর্শক ও উপদেষ্টা সহযোগী অধ্যাপক ড. আশরাফুল আলম বলেন, ‘বিসিএস এবং একাডেমিক বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভিন্ন, বিসিএস প্রস্তুতি মূলত নিজেকেই নিতে হয়। শিক্ষকরা শুধু তাদের ভালো চাকুরীর জন্য মোটিভেট করতে পারে। আর প্রস্তুতি নেওয়ার পরিবেশে ঘাটতি থাকলে প্রশাসন এটার সুবন্দোবস্ত তৈরি করে দিতে পারে। তাছাড়া ঘাটতি আছে যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়টা মফস্বল এলাকায় তাই কোচিং সাপোর্টিভ নয়।’