মঙ্গলবার, ০৫ আগস্ট ২০২৫

|২০ শ্রাবণ ১৪৩২

প্রকাশিত: ১৮:০৯, ২ আগস্ট ২০২৫

আপডেট: ১৮:১৬, ২ আগস্ট ২০২৫

ঢাকায় দ্রোহযাত্রা, প্রতিবাদে উত্তাল সারাদেশ

ঢাকায় দ্রোহযাত্রা, প্রতিবাদে উত্তাল সারাদেশ
ছবি: সদ্য সংবাদ

আবু বকর সিদ্দিক

২০২৪ সালের ২ আগস্ট—বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি সংঘাতময় ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে এদিন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ এবং প্রতিবাদের ঢেউ। এক বছর পরও এ দিনটি সমষ্টিগত স্মৃতি এবং দায়বদ্ধতার প্রতিচ্ছবি হয়ে রয়েছে।

রাজধানীতে ‘দ্রোহযাত্রা’, ঢল নামে মানুষের
সকাল থেকেই জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বরে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, আইনজীবী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। প্রেসক্লাব থেকে শহীদ মিনার পর্যন্ত ‘দ্রোহযাত্রা’য় অচল হয়ে পড়ে পুরো পথ। হাতে প্ল্যাকার্ড, মুখে প্রতিবাদ আর চোখে ক্ষোভ নিয়ে মানুষের সারি শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং বিচারের দাবি জানায়। আন্দোলনে যুক্ত হয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ও স্বাধীন শিল্পীরা। কবিতা, গান, পথনাট্য—সব মিলিয়ে আন্দোলনের আবেগ আরও গভীর হয়। এই কর্মসূচিতে থেকেই ঘোষণা আসে ৪ আগস্ট থেকে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের।

সংঘর্ষে নিহত দুই, ফেসবুক বন্ধ সাত ঘণ্টা
দিনের বিভিন্ন সময় রাজধানীতে আওয়ামী লীগপন্থী কর্মী ও পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। আন্দোলনকারীদের দাবি অনুযায়ী, এতে দুজন নিহত হন। দুপুরের দিকে ফেসবুক সাত ঘণ্টার জন্য বন্ধ হয়ে যায়। আন্দোলনকারীরা একে তথ্যপ্রবাহ রোধের সরকারি কৌশল হিসেবে উল্লেখ করেন। একইদিন আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক অভিযোগ করেন, ২৮ জুলাই রাতে ডিবি হেফাজতে থাকাকালে চাপ প্রয়োগ করে তাঁদের দিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের মিথ্যা বিবৃতি নেওয়া হয়।

শেখ হাসিনার আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন আন্দোলনকারীদের গণভবনে আলোচনার আমন্ত্রণ জানান। বলেন, “গণভবনের দরজা খোলা, আসুন কথা বলি।” আন্দোলনকারীরা প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে জানিয়ে দেন, এত রক্তের স্রোত মাড়িয়ে আলোচনার প্রশ্নই ওঠে না।

খুলনায় পুলিশের মৃত্যু, উত্তপ্ত পরিস্থিতি
খুলনার গল্লামারী এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে নিহত হন পুলিশ সদস্য সুমন কুমার ঘরামী। স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, সংঘর্ষ ভয়াবহ রূপ নেয় এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হয়।

সিলেটে কয়েক ঘণ্টার সংঘর্ষ, শতাধিক আহত
সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত চলে শিক্ষার্থী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ। আন্দোলনকারীরা দাবি করেন, পুলিশের গুলিতে আহত হন ২৫০–৩০০ জন। পুলিশ জানায়, আন্দোলনকারীদের হামলায় সাত পুলিশ সদস্য আহত হন এবং ১২ জনকে আটক করা হয়।

চট্টগ্রাম, ফেনী ও বরিশালেও প্রতিবাদের ঝড়
চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা সন্ধ্যায় সড়কে অবস্থান নেন। ফেনীতে জুমার নামাজের পর খেজুর চত্বরে ‘কাফনের কাপড়’ পরে শিক্ষার্থীরা মিছিল করেন, যা ঘনঘটায় ব্যাপক আলোড়ন তোলে। বরিশালে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা টানা বৃষ্টির মধ্যে হাজারো মানুষের মিছিল করেন। জলাবদ্ধতা সত্ত্বেও থামেনি প্রতিবাদ।

নোয়াখালী, বগুড়া ও নওগাঁয় ব্যতিক্রমী প্রতিক্রিয়া
নোয়াখালীর মাইজদীতে গণমিছিল হয়ে পড়ে প্রধান সড়কে। বগুড়ার সাতমাথা চত্বরে বৃষ্টিতে ভিজেই শিক্ষার্থীরা স্লোগান দেন। নওগাঁয় পুলিশ বিক্ষোভ মিছিল আটকে দেয়, ফলে শিক্ষার্থীরা মসজিদের ভেতর থেকেই অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যান।

আন্তর্জাতিক উদ্বেগ, সরকারের প্রতিক্রিয়া
আন্দোলনকারীরা সরকারের গঠিত তদন্ত কমিশন প্রত্যাখ্যান করেন এবং একে আন্তর্জাতিক মহলকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা বলেন। ইউনিসেফ জানায়, জুলাইয়ের সহিংসতায় অন্তত ৩২ শিশু নিহত হয়েছে, যা গভীর উদ্বেগের বিষয়। তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ওইদিন তরুণদের কাছে নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চান। বলেন, “ইন্টারনেট ব্যাহত হওয়া এবং গুজব রোধে ব্যর্থতার দায় আমি নিচ্ছি।” সেদিনের হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে মোট গ্রেপ্তার করা হয় প্রায় ১১ হাজার মানুষ; তার মধ্যে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় গ্রেপ্তার ২২২।

একটি দিন, একটি স্মৃতি, একটি দায়বদ্ধতা
২০২৪ সালের ২ আগস্ট ছিল শুধুই রক্ত ও প্রতিরোধের নয়, বরং গণতান্ত্রিক অধিকার, জবাবদিহিতা এবং ন্যায্যতার প্রশ্নে জনগণের ঐক্যবদ্ধতার দিন। এক বছর পর এ দিনটি হয়ে উঠেছে ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পালা—যেখানে স্লোগান আর স্মৃতি গেঁথে আছে সময়ের পাতায়।

সম্পর্কিত বিষয়: