বৃহস্পতিবার, ০৭ আগস্ট ২০২৫

|২২ শ্রাবণ ১৪৩২

সদ্য সংবাদ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৭:২৮, ২৫ জুলাই ২০২৫

শিবমন্দির ঘিরে কেন সংঘাতে জড়াল বৌদ্ধ অধ্যুষিত থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া

শিবমন্দির ঘিরে কেন সংঘাতে জড়াল বৌদ্ধ অধ্যুষিত থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া
ছবি: এএফপি

সীমান্তবর্তী একটি প্রাচীন শিবমন্দিরকে কেন্দ্র করে ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সম্পর্ক। গতকাল বৃহস্পতিবার দুই দেশের মধ্যে এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘাত শুরু হয়েছে। সংঘাতে এখন পর্যন্ত অন্তত ১৬ জনের প্রাণহানি হয়েছে, আহত হয়েছে আরও অনেকে। নিরাপত্তার ঝুঁকিতে পড়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছেন দুই দেশের প্রায় দেড় লাখ মানুষ। দ্রুত অবনতিশীল এই পরিস্থিতিতে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কও চরম উত্তেজনায় পৌঁছেছে।

বিরোধের কেন্দ্রে রয়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সীমান্ত এলাকা, যা আন্তর্জাতিকভাবে ‘বিরোধপূর্ণ অঞ্চল’ হিসেবে স্বীকৃত। এই অঞ্চলে অবস্থিত দুটি ঐতিহাসিক হিন্দু মন্দির প্রিয়াহ ভিহিয়ার ও তা মন থম নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে দুই প্রতিবেশী। ২০০৮ সালে কম্বোডিয়া প্রিয়াহ ভিহিয়ার মন্দিরকে ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত করতে উদ্যোগ নেয় এবং সফল হয়। থাইল্যান্ড তাতে তীব্র প্রতিবাদ জানায়, যা পরবর্তীতে রাজনৈতিক উত্তেজনার রূপ নেয়।

দুই মন্দিরই ১১ শতকের খেমার স্থাপত্যের নিদর্শন। দাংরেক পর্বতমালার চূড়ায় প্রায় ৫২৫ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই মন্দিরগুলো ধর্মীয় দিক থেকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি তা জাতীয় গর্ব ও ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের মানুষ মন্দিরগুলোর প্রতি গভীর ধর্মীয় আবেগ পোষণ করে।

সীমান্ত বিরোধের শিকড় গেড়ে রয়েছে ঔপনিবেশিক ইতিহাসে। ফরাসি উপনিবেশিক শাসনের সময় ১৯০৭ সালে প্রণীত একটি মানচিত্রে প্রিয়াহ ভিহিয়ার মন্দিরকে কম্বোডিয়ার অংশ হিসেবে দেখানো হয়। প্রাথমিকভাবে তৎকালীন শ্যাম (বর্তমান থাইল্যান্ড) ওই মানচিত্র মেনে নিলেও পরবর্তীতে দাবি তোলে যে, তারা ভেবেছিল সীমান্ত নির্ধারণ হবে প্রাকৃতিক জলবিভাজিকা ধরে। কিন্তু ফরাসি মানচিত্রে সে নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি বলেই তাদের আপত্তি।

এই বিরোধ আন্তর্জাতিক আদালত পর্যন্ত গড়ায়। ১৯৬২ সালে হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) কম্বোডিয়ার পক্ষে রায় দেয় এবং থাইল্যান্ডকে ওই অঞ্চল থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেয়। সেই সঙ্গে ১৯৫৪ সালের পর মন্দির এলাকা থেকে যেসব প্রত্নসম্পদ সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, তা ফেরত দেওয়ারও নির্দেশ আসে। কিন্তু আদালতের রায় সত্ত্বেও থাইল্যান্ড দীর্ঘদিন ধরে তা কার্যকর করেনি।

২০১৩ সালে আইসিজে ফের রায় ব্যাখ্যা করে জানায়, শুধু মন্দিরই নয়, এর পার্শ্ববর্তী এলাকাও কম্বোডিয়ার অন্তর্ভুক্ত। আদালত আবারও থাইল্যান্ডকে ওই অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়। তবে থাইল্যান্ড এখনো সে নির্দেশ পুরোপুরি মানেনি, ফলে উত্তেজনা আরও বাড়ছে।

সাম্প্রতিক সংঘাত সেই পুরোনো বিরোধেরই ভয়াবহ বহিঃপ্রকাশ। ধর্মীয় ঐতিহ্য, ঔপনিবেশিক ইতিহাস ও আধুনিক ভূরাজনীতির জটিল মিশেলে এই সীমান্ত এলাকা পরিণত হয়েছে এক দাহ্য ইস্যুতে, যার পরিণতিতে রক্তপাত ও মানবিক সংকট ক্রমেই গভীরতর হচ্ছে।