রোববার, ১০ আগস্ট ২০২৫

|২৪ শ্রাবণ ১৪৩২

সদ্য সংবাদ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১০:৩২, ২৬ জুলাই ২০২৫

আপডেট: ১২:৪০, ২৬ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ

বাংলাদেশের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ

বাংলাদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’ (ইউএসসিআইআরএফ)। সংস্থাটি চলতি বছরের জুলাই মাসে তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই উদ্বেগের কথা জানায়।

প্রতিবেদনটি ২০২৪ সালের মে মাসে ঢাকায় কমিশনের সফরের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়। সফরকালে সংস্থার প্রতিনিধি দল সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে। প্রতিবেদনটি লিখেছেন ইউএসসিআইআরএফ-এর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশ্লেষক সীমা হাসান।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন আসে এবং আগস্টে সেনাবাহিনীর সমর্থনে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যদিও নতুন সরকার বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংস্কারের প্রস্তাব দেয়, তবুও ধর্মীয় সহনশীলতা ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।

৫ থেকে ৮ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগ ও সরকার পতনের সময় দেশে কার্যকর কোনো প্রশাসন না থাকায় ব্যাপক সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এ সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর একাধিক হামলার খবর পাওয়া যায়, যা প্রতিশোধমূলক হিসেবে চালানো হয়, আক্রমণকারীরা ভুক্তভোগীদের আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত করেছিল বলে জানানো হয়।

পুলিশের একটি রিপোর্টের বরাত দিয়ে ইউএসসিআইআরএফ জানায়, ৫ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত দেশে মোট ১,৭৬৯টি সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ১,২৩৪টি রাজনৈতিক, ২০টি সাম্প্রদায়িক এবং ১৬১টি ভুয়া অভিযোগের ভিত্তিতে সংঘটিত হয়। একই সময়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ অনেক সংখ্যালঘু মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয় পাহারা দিয়ে সংহতির বার্তা দেয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার একটি সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, যার কিছু প্রস্তাব নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। কমিশন সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘বহুসংস্কৃতিবাদ’ বা ‘বহুত্ববাদ’ শব্দ ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে বিএনপি, যারা এর পরিবর্তে ‘আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা’ শব্দবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে।

ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী এবং আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আংশিক সমর্থন জানিয়ে ‘বহুত্ববাদ’ শব্দের পরিবর্তে বাংলা বিকল্প ‘বহুসংস্কৃতিবাদ’ ব্যবহারের পক্ষে মত দিয়েছে।

২০২৫ সালের মে মাসে নারী সংস্কার কমিশন ৪৩৩টি সুপারিশ পেশ করে, যার মধ্যে একটি হলো ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক আইন প্রণয়নের প্রস্তাব। এটি ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইনকে সম্পূরক করবে। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলাম বিক্ষোভ করে, কমিশনকে ‘ইসলামবিরোধী’ আখ্যা দেয় এবং তাদের সদস্যদের নিয়ে অশালীন মন্তব্য করে। নারীদের বিরুদ্ধে কটূক্তির অভিযোগে ছয় নারী হেফাজতের বিরুদ্ধে আইনি নোটিশ দেন। পরে সংগঠনটি ক্ষমা প্রার্থনা করে।

এছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ফেব্রুয়ারিতে একটি নারী ফুটবল ম্যাচ বাতিল করতে বাধ্য করে এবং নাদিরা ইয়াসমিন নামের এক নারী অধ্যাপককে হুমকির মুখে কলেজ বদল করতে হয়।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে এখনো ধর্ম অবমাননার অভিযোগে দায়ের করা দণ্ডবিধির ধারা ১৯৫এ বলবৎ রয়েছে, যেখানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। ২০২৩ সালের সাইবার সিকিউরিটি আইন অনুযায়ী, ডিজিটাল মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করলে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। এই বিষয়গুলো নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউএসসিআইআরএফ।

সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় সহনশীলতার ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ বিরাজ করছে। সংবিধান সংস্কারে সংখ্যালঘুদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত না হলে ভবিষ্যতে বৈষম্য আরও গভীর হতে পারে। ইউএসসিআইআরএফ-এর মতে, ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষায় বাংলাদেশে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন রয়েছে। সংবিধান সংস্কারের এই সময়ে রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক অংশগ্রহণই দীর্ঘস্থায়ী শান্তির মূল চাবিকাঠি হতে পারে।