ডয়চে ভেলে’র প্রতিবেদন
যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত: নগরীর উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে নতুন বিতর্ক

বাংলাদেশে গত কয়েক দশকের সবচেয়ে প্রাণঘাতী বিমান দুর্ঘটনার পর মঙ্গলবার সারাদেশে শোক পালন করা হয়েছে। জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত ছিল, ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন হয়। সোমবার ঢাকা শহরের কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর (বিএএফ) একটি প্রশিক্ষণ বিমান মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিধ্বস্ত হলে কমপক্ষে ৩১ জন নিহত ও ১৭০ জনের বেশি আহত হন।
নিহতদের মধ্যে ২৫ জন শিশু, একজন শিক্ষক ও পাইলট রয়েছেন, মঙ্গলবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সায়েদুর রহমান। তিনি জানান, দগ্ধ অবস্থায় অন্তত ৮৮ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান মুহাম্মদ ইউনুস এই হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন।
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনা
দুর্ঘটনাকবলিত এফ-৭ বিগিআই বিমানটি চীনে নির্মিত চেংদু জে-৭/এফ-৭ যুদ্ধবিমানের একটি উন্নত সংস্করণ। ২০১১ সালে বাংলাদেশ সরকার এই মডেলের ১৬টি বিমান কেনার চুক্তি করে, এবং ২০১৩ সালের মধ্যে সবগুলো ডেলিভারি সম্পন্ন হয়।
সোমবারের দুর্ঘটনাটি বাংলাদেশে গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী বিমান দুর্ঘটনা বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের বিমান নিয়ে অতীতে একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে।
২০০৮ সালের এপ্রিলে টাঙ্গাইল জেলার একটি গ্রামে এফ-৭ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হলে পাইলট নিহত হন। তিনি একটি যান্ত্রিক ত্রুটি বুঝতে পেরে ইজেক্ট করার পরও প্রাণ হারান। ২০১৫ সালের জুনে চট্টগ্রামের কাছে বঙ্গোপসাগরে একটি এফ-৭ এমবি বিমান বিধ্বস্ত হয়। ওই ঘটনায় পাইলট নিখোঁজ হন। ২০১৮ সালের নভেম্বরে টাঙ্গাইলে একটি এফ-৭ বিগি প্রশিক্ষণ বিমানের দুর্ঘটনায় আরেকজন পাইলট নিহত হন। বিমানটি ঢাকা থেকে উড্ডয়ন করার মাত্র ২৫ মিনিট পরই বিধ্বস্ত হয়ে আগুন ধরে যায়।
লন্ডনভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খান মনে করেন, এসব দুর্ঘটনার পরও বাংলাদেশ বিমানবাহিনী এখনও এফ-৭ ব্যবহার করে অর্থনৈতিক বাস্তবতা, বিদ্যমান অবকাঠামো এবং আধুনিক বিমান সংগ্রহের ধীরগতির কারণে।
তিনি সংবাদমাধ্যম ডিডাব্লিউ-কে বলেন, ‘ইউরোফাইটার কিংবা জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমান সংগ্রহের পরিকল্পনা এগোলেও বাংলাদেশের সীমিত বাজেট ও জটিল ক্রয় প্রক্রিয়ার কারণে এফ-৭ বিমানের ব্যবহার এখনও বন্ধ হয়নি।’
‘নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোর রক্ষণাবেক্ষণ ও দ্রুত আধুনিকায়ন প্রয়োজন, তবে এসব উদ্যোগে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ও যৌক্তিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে’, বলেন তিনি।
সামরিক ঘাঁটি সরিয়ে নেওয়ার জোরালো দাবি
সোমবারের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢাকার সামরিক ঘাঁটিগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার দাবিতে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ মহানগরীগুলোর একটি, যেখানে মাত্র ৩০০ বর্গকিলোমিটার (১১৬ বর্গমাইল) এলাকায় প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ বাস করে।
এই শহরের একটি বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে সামরিক গ্যারিসন, যা অনেকেই নিরাপত্তার কারণে রাজধানীর বাইরে সরিয়ে নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন।
আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, অন্যান্য ক্যান্টনমেন্টগুলো সাধারণত শহরের বাইরে হলেও, ঢাকায় একটি ক্যান্টনমেন্ট শহরের গভীরে অবস্থিত।
তিনি বলেন, ‘এটি এমন একটি নিয়ন্ত্রিত এলাকা, যেখানে সাধারণ মানুষ প্রবেশ করতে পারে না। এটি আরও সমস্যাজনক। কেন দুই শ্রেণির মানুষের ব্যবস্থা থাকবে—এক শ্রেণি ঢুকতে পারবে, অন্যরা পারবে না? অন্যদের জন্য রাস্তা বন্ধ করে রাখা হয়। এর পেছনে কোনো যৌক্তিকতা আমি দেখি না।’
যান্ত্রিক ত্রুটি' দাবির ওপর সন্দেহ
‘দ্য ডেইলি স্টার’-এর রিপোর্টার জাইমা ইসলাম সামরিক বাহিনীর এই দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন যে, দুর্ঘটনার জন্য যান্ত্রিক ত্রুটি দায়ী।
তিনি ডিডাব্লিউ -কে বলেন, ‘আমরা জানি, জনবহুল এলাকাগুলোতে সামরিক বাহিনী যুদ্ধবিমান নিয়ে প্রশিক্ষণ চালিয়ে আসছে।’
‘প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি সত্যিই এমন ঘনবসতিপূর্ণ একটি শহরে সামরিক প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে পারি?’
জাইমা ইসলাম আরও বলেন, এই দুর্ঘটনায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
‘গভীর শোক, ধ্বংসস্তূপ আর ক্রোধের আবহ তৈরি হয়েছে’, বলেন তিনি। ‘কোনো অভিভাবকের সন্তান স্কুলে গিয়ে আর লাশ হয়ে ফিরবে—এটা মেনে নেওয়া যায় না।’
জনবহুল এলাকাজুড়ে প্রশিক্ষণ নিষিদ্ধ করা উচিত
বিএএফ-এর ঢাকা ঘাঁটি দীর্ঘদিন ধরে দেশের প্রধান বেসামরিক বিমানবন্দরের রানওয়ে ব্যবহার করে প্রশিক্ষণ চালিয়ে আসছে।
পর্যবেক্ষকরা জানান, এই রানওয়ের ‘ফাইনাল অ্যাপ্রোচ পাথ বা অবতরণের শেষ ধাপ প্রায় ৬ থেকে ৮ নটিক্যাল মাইলজুড়ে বিস্তৃত এবং এটি উত্তরা অঞ্চলের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর ওপর দিয়ে যায়। মাইলস্টোন স্কুলটি রানওয়ের টাচডাউন পয়েন্ট থেকে মাত্র ১.৯ নটিক্যাল মাইল (৩.৫ কিলোমিটার) দূরে অবস্থিত।
সারা হোসেন মনে করেন, এই ঘটনার পর জনবহুল এলাকাজুড়ে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ ফ্লাইট নিষিদ্ধ করতে সরকারের অবিলম্বে প্রশাসনিক আদেশ জারি করা উচিত।
তিনি বলেন, ‘এই দুর্ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং প্রতিরোধযোগ্য ছিল। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঠেকাতে এখনই প্রশাসনিক উদ্যোগ প্রয়োজন।’
"সামরিক বাহিনী ও বিমানবাহিনীর অনেক খোলা এলাকা রয়েছে, যেখানে অনায়াসেই এ ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। জনবসতিপূর্ণ এলাকায় তা চালানোর কোনো প্রয়োজন নেই।"
দায়ীদের খুঁজে বের করতে হবে
সারা হোসেন আরও বলেন, ‘প্রশিক্ষণের সিদ্ধান্ত কে বা কারা নিয়েছেন, আদৌ কি ঝুঁকিমূল্যায়ন করা হয়েছিল—এটা খতিয়ে দেখতে তদন্ত হওয়া জরুরি। যারা দায়ী, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।’
তবে অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খান মনে করেন, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে জনবহুল এলাকার ওপর প্রশিক্ষণ পরিচালনা করছে না। সমস্যার মূল উৎস হচ্ছে ‘দুর্বল নগর পরিকল্পনা’।
তিনি ডিডাব্লিউ -কে বলেন, ‘আসল সমস্যা হচ্ছে দুর্বল নগর পরিকল্পনা এবং এলোমেলো জোনিং নীতিমালা, যার ফলে এমন ঝুঁকিপূর্ণ অ্যাভিয়েশন জোনে একটি স্কুল গড়ে উঠেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটি) এবং স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে তারা কীভাবে রানওয়ের কাছে জনবসতি ও অবকাঠামো গড়ে তোলার অনুমতি দিয়েছে?’
‘জনগণের মনোযোগ এখন হওয়া উচিত কঠোর জোনিং আইন ও উন্নত নগর পরিকল্পনা দাবির দিকে, কারণ রানওয়ে সরিয়ে নেওয়া খরচ ও জমির সীমাবদ্ধতার কারণে বাস্তবসম্মত নয়’, যোগ করেন খান।