‘কোনো সাংবাদিক এখনো সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্নটি তোলেননি, কে সেই বন্ধু’?

বাংলাদেশ প্রায় দুই দশক ধরে এমন উৎসবমুখর নির্বাচন প্রত্যক্ষ করেনি। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন মূলত একটি ছাত্রসংসদের ভোট, এর তাৎপর্য অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। বিপুল ভোটার উপস্থিতি দীর্ঘদিনের দমিত ভোটাধিকার প্রয়োগের আকাঙ্ক্ষাকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে’ বলে মন্তব্য করেছেন আল জাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের। তিনি বলেন, এটি শুধু ছাত্ররাজনীতির প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না, বরং গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের প্রতীকী ঘোষণা। তাই ফলাফল যেমনই হোক না কেন, সব রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীকে তা মেনে নেওয়াই শ্রেয় হবে।
মঙ্গলবার ( ৯ সেপ্টেম্বর) এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি এক কথা বলেন। তিনি বলেন, তবে এক স্বতন্ত্র প্রার্থী রূপাইয়া তঞ্চঙ্গ্যার একটি অভিযোগ সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি দাবি করেছেন, একটি ব্যালটে আগে থেকেই চিহ্ন দেওয়া ছিল—কিন্তু তিনি নিজে দেখেননি; একজন বন্ধুর মুখে শুনেছেন। বিস্ময়করভাবে, কোনো সাংবাদিক এখনো সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্নটি তোলেননি: কে সেই বন্ধু, রহস্যময় সেই ভোটার কেনো সামনে আসছেন না? এমন সময়ে যখন নির্বাচন পর্যবেক্ষণে প্রযুক্তি ও পর্যবেক্ষক উভয়ই সক্রিয়, তখন এ ধরনের এক তরফা যাচাইবিহীন শোনা-কথা প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
অনুসন্ধানী সাংবাদিক বলেন, তার উপর অভিযোগটি শুধু অযাচাইকৃতই নয়, যুক্তির দিক থেকেও দুর্বল। অভিযোগের দাবি হলো, পোলিং অফিসার গোপনে একটি ব্যালট চিহ্নিত করেছে এবং পরে সেটি ভোটারের হাতে দিয়েছে। বিষয়টি একেবারেই অযৌক্তিক। এটি এমন যেন একজন চোর বাড়ি থেকে চুরি করে নিয়ে এসে মালিককেই অনুরোধ করছে চুরি হওয়া জিনিস বাইরে নিয়ে যেতে। ভোট কারচুপি যদি সত্যিই করার চেষ্টা হতো, তবে এটি সবচেয়ে নির্বোধ কৌশল হতো, কারণ ব্যালট হাতে পাওয়া ভোটার তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগ তুলতেই পারেন।
জুলকারনাইন বলেন, নির্বাচনী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যিনি ব্যালট আগে থেকেই চিহ্নিত ছিল বলে দাবি করেছেন তিনি কিছু সময় বুথে কাটিয়ে এসেছেন। সেই যদি বুথে প্রবেশ করেন, কিছুক্ষণ ভেতরে অবস্থান করেন, এরপর বের হয়ে এসে বলেন যে ব্যালটটি আগেই চিহ্নিত ছিল। স্বাভাবিকভাবেই এই আচরণ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে এবং এর পেছনে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ধরে নিলেও যে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে, তা সর্বোচ্চ বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনা। হাজার হাজার ভোটারের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনকে শুধুমাত্র একটি অযাচাইকৃত অভিযোগের ভিত্তিতে বাতিল করা যায় না। এ কারণেই সেখানে সিসিটিভি ক্যামেরা ও নির্বাচনী কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন—যাতে কোনো অনিয়ম ঘটলে তা তদন্ত করা যায় এবং পুরো প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট না হয়। একটি সামান্য অভিযোগের কারণে পুরো নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী।
জুলকারনাইন আরো বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভোটারদের মনোভাব। অনেক নন-রেসিডেন্ট ভোটার, যারা বছরের পর বছর ব্যালট দিতে পারেননি, তাঁরা আনন্দের সাথে এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। সামাজিক মাধ্যমের গুজব তাদের উদ্দীপনা মুছে দিতে পারে নি।বাংলাদেশ এখন সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন, তা হলো বারবার সৎ ও নিয়মিত নির্বাচন। কারণ নির্বাচনের মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে এবং জবাবদিহিতা জোরদার হয়। তাই ডাকসুর ফলাফল সব রাজনৈতিক পক্ষ হাসিমুখে মেনে নিলে এতে বরং গনতন্ত্রের ভীত পোক্ত হবে। ফলাফল যদি কোনো একটি দলের—হোক সেটা শিবির বা ছাত্রদল, কিংবা বাম—পক্ষে যায়, সেটিকেও স্বীকার করতে হবে।
এই সাংবাদিক বলেন, গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হলো পরাজয় মেনে নেওয়া এবং পরবর্তী প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত থাকা। তাই বিচ্ছিন্ন অভিযোগকে বাড়িয়ে না তুলে বরং স্বচ্ছ ও নিয়মিত নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক করার দিকেই মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। কেবল তখনই ছাত্রসংসদের নির্বাচনে প্রকাশিত এই গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা জাতীয় গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী ও টেকসই করে তুলতে পারবে। ডাকসুর অভিজ্ঞতা একটি বার্তা দিয়েছে: বাংলাদেশের মানুষ ভোট দিতে চায়। তারা চায় তাদের কণ্ঠস্বর শোনা হোক। তাই সব দলের উচিৎ পিআর-টিআর-এর টালবাহানা বাদ দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হওয়া। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যারাই নানা রকমের টালবাহানা করবেন, তাঁরা বরং এসব করে মানুষের গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণকে ব্যহত করবেন এবং ফলে জনগণকে নিজ প্রতিপক্ষে রুপান্তরিত করে ফেলবেন, এহেন আচরণ পতিত স্বৈরাচারের ফেরার পথ আরো সুগম করবে।