ইরাক ধ্বংসের অন্যতম হোতা সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি মারা গেছেন
গণবিধ্বংসী অস্ত্র (ডব্লিউএমডি) থাকার মিথ্যা অভিযোগে সাদ্দাম হোসেনের সরকার পতন ও ইরাক ধ্বংসের অন্যতম নেপথ্য কারিগর সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। চেনির পরিবার এক বিবৃতিতে তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে।
ডিক চেনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির এক প্রভাবশালী ও বিতর্কিত ব্যক্তি। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ, কংগ্রেস সদস্য, প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং ভাইস প্রেসিডেন্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসনে ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তিনি সরকারের নেপথ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হন। বুশের চেয়ে কম অভিজ্ঞ হলেও প্রশাসনিক ও নিরাপত্তানীতিতে তাঁর প্রভাব ছিল ব্যাপক।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে সন্ত্রাসী হামলার সময় প্রেসিডেন্ট বুশকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হলে চেনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ডের সঙ্গে মিলে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নেন। এর অল্প সময় পরই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে।
তবে ইতিহাসে ডিক চেনির নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয় ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধের সিদ্ধান্তের কারণে। প্রেসিডেন্ট বুশের সঙ্গে তিনি দাবি করেছিলেন, ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে এবং তিনি আল-কায়েদার সঙ্গে যুক্ত। পরবর্তীতে এসব দাবির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবু চেনি পরবর্তীকালে লিখেছিলেন, ‘দেশ রক্ষায় যা কিছু করা প্রয়োজন ছিল, আমরা তা করেছি।’
ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটসন স্কুলের হিসাব অনুযায়ী, ২০০১ সালের পর থেকে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইয়েমেন ও পাকিস্তানে অন্তত আট লাখ মানুষ সরাসরি যুদ্ধ ও সহিংসতায় নিহত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ চলাকালে বন্দীদের ওপর নির্যাতনের অনুমোদন ও সমর্থনের কারণে চেনি তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন। তবে তিনি অবসরের পরও নিজের সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে দাবি করে গেছেন।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়েই চেনি পড়াশোনা শেষ না করে রাজনীতিতে যুক্ত হন। ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ না নিলেও পরে রিপাবলিকান রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। রিচার্ড নিক্সনের আমলে তিনি হোয়াইট হাউসের সহকারী, জেরাল্ড ফোর্ডের আমলে সর্বকনিষ্ঠ চিফ অব স্টাফ, রোনাল্ড রিগ্যানের সময় কংগ্রেস সদস্য, জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশের আমলে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং সর্বশেষ জর্জ ডব্লিউ বুশের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
২০০০ সালের নির্বাচনে বুশ তাঁকে তেল কোম্পানি হ্যালিবার্টন করপোরেশন থেকে ডেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করেন। তত দিনে তিনি তিনবার হার্ট অ্যাটাক থেকে বেঁচে ফিরেছিলেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে একবার শিকার অভিযানে ভুলবশত তাঁর এক সহযোগীর মুখে গুলি করার ঘটনাও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
চেনির মেয়ে লিজ চেনি বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ওয়াইমিং থেকে কংগ্রেস সদস্য নির্বাচিত হন—যে আসনে একসময় ডিক চেনি নিজেও ছিলেন। তবে ২০২১ সালে ট্রাম্পবিরোধী অবস্থান নেওয়ায় রিপাবলিকান পার্টি থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়।
এক বছর পর ক্যাপিটল হিল দাঙ্গার স্মরণসভায় অংশ নিয়ে চেনি বলেন, ‘বর্তমান রিপাবলিকান নেতৃত্ব আমার সময়ের কারও মতো নয়। ৬ জানুয়ারির ঘটনাটিকে কখনোই হালকাভাবে নেওয়া যাবে না।’
২০২৪ সালে তিনি প্রকাশ্যে জানান, আসন্ন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প নয়, বরং কমলা হ্যারিসকে ভোট দেবেন। তাঁর ভাষায়, ‘আমেরিকার ২৪৮ বছরের ইতিহাসে ট্রাম্পের চেয়ে বড় হুমকি গণতন্ত্রের জন্য আর কেউ নন।’
চেনিকে অনেকেই ‘স্টার ওয়ার্স’ সিরিজের চরিত্র ‘ডার্থ ভেডার’-এর সঙ্গে তুলনা করতেন, আর তিনি নিজেও এই উপাধি পছন্দ করতেন। তাঁর জীবনীকার জ্যাক বার্নস্টিন ২০১৮ সালে দ্য গার্ডিয়ান-কে বলেন, ‘চেনি কখনোই তাঁর ভাবমূর্তি নরম করতে চাননি। বরং তিনি উপভোগ করতেন যে মানুষ তাঁকে ‘ডার্থ ভেডার’ বলে ডাকে।’



























