শুক্রবার, ০৮ আগস্ট ২০২৫

|২২ শ্রাবণ ১৪৩২

সদ্য সংবাদ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৬:৫১, ২০ জুলাই ২০২৫

আপডেট: ১৬:৫৩, ২০ জুলাই ২০২৫

পরিকল্পিতভাবে গাজার হাজার হাজার ভবন ধ্বংস করছে ইসরায়েল

পরিকল্পিতভাবে গাজার হাজার হাজার ভবন ধ্বংস করছে ইসরায়েল
ছবি: সংগৃহীত

মার্চে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি প্রত্যাহারের পর থেকে ইসরায়েল গাজাজুড়ে হাজার হাজার ভবন গুঁড়িয়ে দিয়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে পুরো শহর এবং তার আশপাশের এলাকা ধ্বংস করে ধূলিসাৎ করা হয়েছে, যেখানে এক সময় হাজার হাজার মানুষ বসবাস করত। খবর! বিবিসি বাংলা।

স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যাচ্ছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী যে এলাকাগুলো ‘অপারেশনাল নিয়ন্ত্রণে’ রয়েছে বলে দাবি করেছে, সেখানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। এসব ধ্বংস মূলত পরিকল্পিত এবং নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে, যেখানে অনেক অক্ষত ভবনও গুঁড়িয়ে ফেলা হয়েছে।

বিবিসি ভেরিফাই যাচাই করা ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, টাওয়ার ব্লক, স্কুল ও অন্যান্য স্থাপনায় বিস্ফোরণে ধুলো ও ধ্বংসাবশেষের বিশাল মেঘ সৃষ্টি হয়েছে। একাধিক আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ বলছেন, এই ধ্বংসযজ্ঞ সম্ভবত জেনেভা কনভেনশনের আওতায় যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, কারণ দখলদার শক্তির পক্ষে এমন ধ্বংস নিষিদ্ধ।

ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ) জানিয়েছে, তারা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কাজ করছে এবং হামাস বেসামরিক এলাকায় সামরিক সরঞ্জাম লুকিয়ে রেখেছে বলে দাবি করেছে। আইডিএফ বলছে, শুধুমাত্র সামরিক প্রয়োজনে অবকাঠামো ধ্বংস করা হয়েছে।

রাফা শহরের বিশাল অংশ সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। শিক্ষাবিদ কোরি শের ও জ্যামন ভ্যান ডেন হোকের বিশ্লেষণে দেখা যায়, এপ্রিল থেকে গাজার সবচেয়ে বড় ধ্বংসযজ্ঞ এই এলাকাতেই হয়েছে। নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ, এক্সক্যাভেটর ও বুলডোজার ব্যবহার করে পুরো অঞ্চল গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

ইসরায়েল দাবি করছে, গাজার অধিকাংশ এলাকা এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যেগুলো সামরিক জোন হিসেবে বিবেচিত অথবা খালি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মার্চে যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পর, বিবিসি ভেরিফাই অন্তত ৪০টি স্থানে অবকাঠামো ধ্বংসের ভিডিও শনাক্ত করেছে।

স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, এসব এলাকায় আগের বোমাবর্ষণে আংশিক ক্ষতি হলেও ডজনখানেক ভবন টিকে ছিল। তবে ১৩ জুলাইয়ের মধ্যে পুরো ব্লক মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়, কেবল একটি হাসপাতাল ছাড়া। পাশের সৌদি পাড়ায়ও ধ্বংস কাজ চলছে, যেখানে একসময় শহরের সবচেয়ে বড় মসজিদ ও স্কুলগুলো ছিল।

রাফাহ শহরের এক রাস্তায় একটি ট্যাংক চলার পাশেই একটি ভেকু ধ্বংস কাজ চালাচ্ছে—এমন দৃশ্য দেখা গেছে এক যাচাই করা ভিডিওতে। গাজার অন্যান্য এলাকাতেও একই ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, এমনকি যেসব স্থানে আগের বোমাবর্ষণে খুব একটা ক্ষতি হয়নি সেগুলোতেও।

খুজাহ নামের কৃষিভিত্তিক জনপদ, যা ইসরায়েল সীমান্ত থেকে ১.৫ কিলোমিটার দূরে, মে মাস পর্যন্ত প্রায় অক্ষত ছিল। কিন্তু জুনের মাঝামাঝি সময়ে অধিকাংশ এলাকা ধ্বংস হয়ে যায়। আইডিএফ বলছে, সেখানে তারা ১,২০০টি ভবন ধ্বংস করেছে যেগুলো “হামাস পরিচালিত সন্ত্রাসী অবকাঠামো” ছিল।

পাশের শহর আবাসান আল-কাবিরাতেও একই ধরণের ধ্বংস দেখা গেছে, যেখানে মাত্র ৩৮ দিনের ব্যবধানে বিশাল এলাকা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েল গাজায় ‘নিরাপত্তা করিডর’ ও ‘বাফার জোন’ তৈরি করছে, যার জন্য বিভিন্ন রুটের পাশে অসংখ্য ভবন ধ্বংস করা হয়েছে। সর্বশেষ করিডরটি খান ইউনিসের পশ্চিম অংশকে পূর্বাংশ থেকে আলাদা করেছে, যার মধ্যে রয়েছে খুজাহ ও আবাসান আল-কাবিরা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধের শুরু থেকেই সীমান্তবর্তী ভবন ধ্বংস করে ইসরায়েল গভীর ‘বাফার জোন’ তৈরি করতে চাচ্ছে, যদিও সাম্প্রতিক ধ্বংস গাজার অনেক গভীর অংশেও চালানো হয়েছে।

কিজান আবু রাশওয়ান নামে একটি কৃষিপ্রধান গ্রামে ১৭ মে’র পর থেকে প্রায় সব অবশিষ্ট ভবন ধ্বংস করা হয়েছে। বিবিসি যাচাই করা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণে একসঙ্গে একাধিক বহুতল ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

বিবিসি ভেরিফাই আইডিএফ-এর কাছে ধ্বংসকৃত এলাকাগুলোর তালিকা দিয়ে সামরিক ব্যাখ্যা চাইলেও তারা কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেয়নি। আইডিএফ শুধু বলেছে, হামাস ও অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠন বেসামরিক এলাকায় সামরিক সম্পদ লুকিয়ে রাখে এবং আইডিএফ এসব অবকাঠামো শনাক্ত ও ধ্বংস করে।

মানবাধিকার আইনজীবীরা বলছেন, এই অভিযান আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধের মধ্যে পড়তে পারে। জেরুজালেমভিত্তিক ডায়াকোনিয়া ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যানিটারিয়ান ল’ সেন্টারের জ্যেষ্ঠ আইন বিশেষজ্ঞ ইতান ডায়মন্ড বলেন, চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের আওতায় সাধারণ বেসামরিকদের সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয় এবং এই ধরণের ধ্বংস তার পরিপন্থী।

অক্সফোর্ড ইনস্টিটিউট ফর এথিকস, ল’ অ্যান্ড আর্মড কনফ্লিক্টের সহ-পরিচালক অধ্যাপক জানিনা ডিল জানান, কোনো দখলদার শক্তির কর্তব্য হচ্ছে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা। কিন্তু এমন কৌশল, যা বসবাসযোগ্য এলাকা ধ্বংস করে দেয়, তা আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।