কুড়িগ্রামে দুই বছর ধরে পিয়নের বেতন বন্ধ, মাউশির নির্দেশ অমান্য প্রধান শিক্ষক-ইউএনওর
কুড়িগ্রামের রৌমারীতে যাদুরচর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অফিস সহায়ক (সাবেক পিয়ন) বাবলু মিয়ার বেতন–ভাতা টানা দুই বছর ধরে অবৈধভাবে বন্ধ রাখার অভিযোগ উঠেছে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতির বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) বকেয়া বেতন–ভাতা পরিশোধ এবং এমপিও–সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনের নির্দেশ দিলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। বরং ভুক্তভোগীকে ভয়ভীতি দেখানো, চাকরিচ্যুতির উদ্দেশ্যে জোর করে ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেওয়া এবং শারীরিক হেনস্তার মতো গুরুতর অভিযোগও উঠেছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।
২০০৯ সালে ‘পিয়ন’ পদে নিয়োগ পান বাবলু মিয়া। ২০২১ সালের সরকারি পরিপত্রে দেশের সব বিদ্যালয়ে ‘পিয়ন’ পদটির নাম পরিবর্তন করে ‘অফিস সহায়ক’ করা হয়। কিন্তু যাদুরচর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল মতিন এই সরকারি সিদ্ধান্ত মানতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি একই পদে নতুন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেন।
বাবলু মিয়া বিষয়টি আদালতে চ্যালেঞ্জ করলে আদালত তাঁর পক্ষে রায় দেন এবং নতুন নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। পরে প্রধান শিক্ষক ‘মিস অ্যাপিল’-এ ভুল তথ্য দিয়ে আবারও স্থগিতাদেশ নেন। যদিও একই দিনে ভুক্তভোগী রিভিউ আবেদন করলে শুনানির তারিখ নির্ধারিত হয়। সেই শুনানির আগেই তড়িঘড়ি করে মাত্র তিন দিনের মধ্যে অফিস সহায়ক পদে নতুন নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়, যা ছিল পুরোপুরি অবৈধ।
প্রধান শিক্ষক বাবলুর বিরুদ্ধে মাউশিতে একটি অভিযোগ দাখিল করেন। ওই অভিযোগের শুনানিতে ২০২৪ সালের ২১ নভেম্বর মাউশি বাবলুর পক্ষে রায় দেয়। এরপর ৩১ ডিসেম্বর জারি করা চিঠিতে মাউশির মহাপরিচালক বন্ধ থাকা বকেয়া বেতন–ভাতা দ্রুত পরিশোধ এবং বাবলুকে স্বপদে বহাল রেখে এমপিওভুক্তির ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।
কিন্তু সাত মাস পার হলেও প্রধান শিক্ষক আব্দুল মতিন এবং বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উজ্জল কুমার হালদার কোনো নির্দেশই বাস্তবায়ন করেননি। বরং তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠে আরও গুরুতর অভিযোগ।
গত ১২ এপ্রিল বিদ্যালয়ের অফিসকক্ষে প্রধান শিক্ষক ও তাঁর সহযোগীরা বাবলুকে ডেকে নিয়ে ৩০০ টাকার নন–জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে জোরপূর্বক স্বাক্ষর করান বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী। এ সময় তাঁকে শারীরিকভাবে হেনস্তাও করা হয় বলে তিনি জানান।
তিনি আরও জানান, ঘটনাস্থল থেকে বের হয়েই তিনি ইউএনওকে ফোনে বিষয়টি জানান এবং পরে লিখিত অভিযোগও দাখিল করেন।
সহকারী শিক্ষক ছামান আলী স্বীকার করেন যে “মিউচুয়াল সমাধানের” নামে ওই দিন বাবলুর কাছ থেকে ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছিল।
প্রধান শিক্ষক আব্দুল মতিন দাবি করেন, “হাইকোর্টে মামলা চলমান থাকায় বেতন দেওয়ার এখতিয়ার নেই।”
কিন্তু তদন্তে দেখা যায়, মামলাটির শুনানিতে বাবলু ইতোমধ্যেই রায় পেয়েছেন এবং বেতন বন্ধ রাখার মতো কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকার প্রমাণ প্রধান শিক্ষক বা ইউএনও কেউই দেখাতে পারেননি।
বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও ইউএনও উজ্জল কুমার হালদার বলেন, “নিষেধাজ্ঞার কারণে বেতন বন্ধ।” কিন্তু তিনি কোনো নথি বা সরকারি আদেশ দেখাতে ব্যর্থ হন।
দীর্ঘ দুই বছর বেতন না পেয়ে বাবলু মিয়া পরিবার নিয়ে চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। অসুস্থ স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন বলে জানান তিনি। তিনি অভিযোগ করে বলেন, “ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলেও তাদের সহযোগী এই প্রধান শিক্ষক আজও দাপট দেখাচ্ছেন; আমার কোনো প্রতিকার মিলছে না।”
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, “বেতন–ভাতা বন্ধ থাকার বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”



























