শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫

|৩০ কার্তিক ১৪৩২

সদ্য সংবাদ অনলাইন

প্রকাশিত: ২১:১৯, ৪ নভেম্বর ২০২৫

এশিয়া টাইমসের প্রতিবেদন

সালাহউদ্দিন আহমেদের উত্থান, নতুন রাজনৈতিক আখ্যান যুক্তির ভাষায় 

সালাহউদ্দিন আহমেদের উত্থান, নতুন রাজনৈতিক আখ্যান যুক্তির ভাষায় 
গণঅভ্যুত্থানের পর দীর্ঘ ৯ বছরের নির্বাসন ত্যাগ করে দেশে ফেরেন সালাহউদ্দিন আহমদ। ছবি: বিএনপির ওয়েবসাইট

বাংলাদেশের রাজনীতি বরাবরই উত্তেজনা, আবেগ ও কটূক্তির মধ্যে আবদ্ধ। যুক্তি ও সংযমের কণ্ঠস্বর সেখানে প্রায়ই হারিয়ে যায় রাজনৈতিক কোলাহলে। তবে সেই ধারার বিপরীতে এক ভিন্ন সুর এনেছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তার শান্ত, যুক্তিনির্ভর ও সংযত বক্তব্য এখন অনেকের কাছে রাজনীতিতে এক নতুন বাতাসের মতো মনে হচ্ছে।

২০২৪ সালের জুলাইয়ে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের পতনের পর বাংলাদেশে ঘটে বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে গড়ে ওঠা সেই গণ-অভ্যুত্থান দেশের রাজনীতিতে নতুন সম্ভাবনার সূচনা করে। এই প্রেক্ষাপটেই দৃঢ় অথচ সংযত কণ্ঠে আত্মপ্রকাশ করেন সালাহউদ্দিন আহমেদ।

তবে তার এই পুনরুত্থানের পেছনে রয়েছে এক নাটকীয় অতীত। শেখ হাসিনার শাসনামলে ভিন্নমতের নেতা-কর্মীদের ওপর নিপীড়ন চলছিল। ২০১৫ সালের ১০ মার্চ ঢাকার উত্তরা এলাকা থেকে সালাহউদ্দিনকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে। প্রায় দুই মাস নিখোঁজ থাকার পর তিনি ভারতের শিলং শহরে আটক অবস্থায় উদ্ধার হন। একসময় এই ঘটনাই তার রাজনৈতিক জীবনের সমাপ্তি টানতে বসেছিল, কিন্তু আজ সেটিই যেন তার নতুন রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত গুম কমিশন পরে নিশ্চিত করে যে, সালাহউদ্দিন আহমেদ ছিলেন রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের এক স্পষ্ট উদাহরণ। ২০২৫ সালের ৩ জুন তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন, যেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আরও সাতজনকে তার অপহরণ ও আটক রাখার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়।

ভারতে প্রায় নয় বছর কাটানোর কারণে তার রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা তৈরি হয়। কেউ কেউ অভিযোগ তোলে, তিনি নাকি ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে এসব অভিযোগের জবাবে সালাহউদ্দিন তথ্য ও যুক্তির মাধ্যমে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেন। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বরাবরই সংবেদনশীল ছিল, বিশেষত শেখ হাসিনার সময়ে ভারতের নীরব সমর্থন অনেকের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয়। তাই তার দীর্ঘ বিদেশে থাকা সন্দেহের কারণ হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার সংযত ও বাস্তবধর্মী রাজনীতি সেই সন্দেহ দূর করেছে।

২০২৪ সালের আগস্টে দেশে ফেরার পর সালাহউদ্দিন দ্রুতই বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ মুখ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় বিএনপির প্রতিনিধি হিসেবেও তিনি যুক্ত হন। কমিশনের লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা তৈরি ও ভবিষ্যতে কর্তৃত্ববাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধে কাঠামোগত সংস্কার প্রস্তাব করা।

এই দায়িত্বে তার ভূমিকা ছিল যুক্তিনির্ভর, পরিমিত ও বাস্তববাদী। আবেগের পরিবর্তে তিনি তুলে ধরেন বিশ্লেষণ, স্লোগানের পরিবর্তে যুক্তি, ক্রোধের পরিবর্তে সংযম। তার এই শান্ত কণ্ঠস্বর অনেকের কাছেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন সম্ভাবনার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, সালাহউদ্দিন আহমেদের উত্থান শুধু একজন নেতার পুনরাগমন নয়—এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবর্তনের সংকেত। দীর্ঘদিনের সংঘাত ও সহিংস রাজনীতির বাইরে যুক্তি, সংযম ও শালীনতার ভিত্তিতে নতুন এক রাজনৈতিক ভাষা গড়ে উঠছে।

২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি নিজেদের নতুনভাবে সাজাচ্ছে। দলের ভেতরে যুক্তিনির্ভর এই নতুন ধারার মুখপাত্র হিসেবে উঠে আসছেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। রাজনৈতিক কোলাহলের মাঝে তার শান্ত, সংযত কণ্ঠ যেন ইঙ্গিত দিচ্ছে এক নতুন যুগের—যেখানে তর্কের বদলে যুক্তি, উত্তেজনার বদলে সংযম, আর আবেগের বদলে নীতিনিষ্ঠ আলোচনাই রাজনীতির চালিকা শক্তি।