বুধবার, ০১ অক্টোবর ২০২৫

|১৪ আশ্বিন ১৪৩২

সদ্য সংবাদ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১১:৩৫, ১১ জুলাই ২০২৫

আপডেট: ১২:৩৩, ১১ জুলাই ২০২৫

স্বৈরাচারের অতীত থেকে গণতন্ত্রের নতুন স্বপ্ন: পিআর পদ্ধতি কি ও কেন প্রয়োজন?

স্বৈরাচারের অতীত থেকে গণতন্ত্রের নতুন স্বপ্ন: পিআর পদ্ধতি কি ও কেন প্রয়োজন?
ছবি: সংগৃহীত

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায় সূচনা হয়েছে। সেই সাথে আমূল পরিবর্তন হয়েছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে নতুন করে কোন স্বৈরাচার শাসক তৈরি হতে পারবে না, তার নতুন বন্দোবস্ত তৈরি করছে জুলাই শহীদদের রক্তের উপর শপথ নেয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিশেষ করে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার আমলে প্রহসনের যে তিনটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে, সেভাবে যেন আর কোন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হয় নতুন বাংলাদেশ এর নাগরিকদের সেই প্রত্যাশা পূরণে কাজ করছে অধ্যাপক ড. ইউনুসের নেতৃত্বের সরকার। তারা চায় বাংলাদেশের ইতিহাসের সব থেকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে।

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে যেমন মানুষের মাঝে আশা-প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে। তেমনি রাজনৈতিক অঙ্গনে সহমত-ভিন্নমতের সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো যেমন নিজেদের নতুন করে সাজাচ্ছে, তেমনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন করে শব্দ যুক্ত হচ্ছে। সহজে বললে শব্দটি একটি নির্বাচন প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি। যা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে নতুন তো বটেই, অনেকে এই পদ্ধতি নাম জীবনে প্রথমবার শুনছে।

বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ, আর গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া। তবে দেশে প্রচলিত যে ভোট দেয়ার পদ্ধতি রয়েছে, তাতে অনেক সময় মানুষের মতামতে প্রতিফলিত করে না। দেখা যায় অনেক রাজনৈতিক দল নির্বাচনে সীমিত বা কম ভোট পেয়ে অনেক বেশি আসন জয় লাভ করে। অন্য দিকে অধিক শতাংশ ভোট পাওয়া দলও কোনও আসন পায় না। যেটা ভোটের নির্বাচনের জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে বৈষম্য সৃষ্টি করে। আর এই বৈষম্যে থেকে বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনীতিতে প্রপোরশনাল রি-প্রেজেন্টেশন (পিআর) বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে তোড়জোড় চলছে।

সম্প্রতি দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন এন্ড ডেমোক্রেসির আয়োজনে অনুষ্ঠিত সেমিনারে বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টিসহ বহু দল উপস্থিত ছিল।  সেখানে মধ্য ও ছোট দলগুলোর বড় অংশ বিদ্যমান ভোট ব্যবস্থার পরিবর্তে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতির পক্ষে মত প্রকাশ করে। অনেক দলই প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে হওয়া সংলাপে পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দাবিও জানিয়েছে।  তবে বিএনপি এই পদ্ধতির বিরোধিতা করেছে এবং বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সমর্থন করে আসছে। 

পিআর পদ্ধতি কি?

ফেয়ার ভোট কানাডার তথ্য অনুযায়ী, প্রপোরশনাল রি-প্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতি হলো এমন একটি প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি যা বলে যে কোনও দলের আইনসভায় (সংসদ)-এ আসনের শতকরা অংশ হওয়া উচিত সেই দলের জন্য ভোট দেয়া মানুষের শতকরা অংশের সমান। যদি কোনও দল ৪০% ভোট পাবে, তাহলে তাদের ৪০% আসন পাওয়া উচিত।

অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের নির্বাচন কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, প্রপোরশনাল রি-প্রেজেন্টেশন (পিআর) হলো এমন একটি শব্দ যা বহুমত-দলীয় ভোটদান ব্যবস্থাগুলোর একটি দলকে বর্ণনা করে, যেগুলো ব্যবহার করা হয় বহু আসন বিশিষ্ট নির্বাচনী অঞ্চলে প্রার্থী নির্বাচনের জন্য। পিআর-এর অধীনে, দল, গ্রুপ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তাদের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সংসদে নির্বাচিত হন। একটি বিধানসভা বা সংসদের গঠন যেখানে সদস্যরা পিআর ব্যবস্থায় নির্বাচিত হন, সাধারণত রাজ্য বা অঞ্চলের সর্বত্র প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতকে অনেক ভালোভাবে প্রতিফলিত করে, তুলনায় এমন সংসদের যেখানে সদস্যরা একক আসন বিশিষ্ট নির্বাচনী অঞ্চলের মাধ্যমে নির্বাচিত হন।

এক কথায়, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর হচ্ছে এমন এক নির্বাচনী ব্যবস্থা পদ্ধতি যেখানে আসন বণ্টন হয় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে যদি কোন দল মোট প্রদত্ত ভোটের শতকরা ২৫ শতাংশ পায়, তাহলে সেই দল আনুপাতিক হারে সংসদের ২৫ শতাংশ বা ৭০টি আসন পাবেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পিআর বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে মুক্ত, গোপন ও মিশ্র তিনটি আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা রয়েছে ।

পিআর পদ্ধতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

পিআর পদ্ধতির সূচনা ১৯শ শতকের শেষভাগে ইউরোপে হয়, যেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বকে আরও ন্যায্য করতে কাজ শুরু হয়। সুইজারল্যান্ড ও বেলজিয়াম এই পদ্ধতি গ্রহণ করে উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পিআর পদ্ধতি অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, কারণ এটি সংখ্যালঘু ও ছোট দলগুলোকে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ দেয় এবং রাজনৈতিক বৈচিত্র্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। বেলজিয়ামে ১৮৯৯ সালে প্রথম এই পদ্ধতিটি চালু হয়। বর্তমানে বিশ্বের ১৭০টি গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে ৯১টি দেশে, যা মোটের উপর ৫৪ শতাংশ, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতি কেন প্রয়োজন?

বাংলাদেশে বর্তমানে নির্বাচন ব্যবস্থায় প্রধানত প্রথম-পাস্ট-দ্য-পোস্ট (FPTP) পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যেখানে নির্বাচনী এলাকা থেকে একমাত্র জনপ্রিয় প্রার্থী জয়ী হন। অর্থাৎ, বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক দল দল বেশি আসনে জয় পাবে, তারা সরকার গঠন করে, ভোটের মোট শতাংশ উপর নির্ভর করতে হয় না।

উদাহরণ: উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ১৯৩ আসনে জয় লাভ করে যেখানে তাদের প্রদত্ত ভোটের পরিমাণ ছিল ৪০.৮৬ শতাংশ। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ৪০.২২ শতাংশ ভোট পেয়েও আসন পায় মাত্র ৬২টি। তেমনি ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৮.০৪ শতাংশ ভোট পেয়ে ২৩০টি আসন পেয়েছিল, যেখানে বিএনপি ৩০ আসন পেয়েছিল কিন্তু তাদের প্রদত্ত ভোটের পরিমাণ ছিল ৩২.৫০ শতাংশ।

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা কেবল রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করে না, এটি গণতন্ত্রকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর করার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। উন্নত দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন নির্বাচনের বৈষম্যমূলক ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই পদ্ধতি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বিশেষ প্রাসঙ্গিক।

বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর এখন সময় এসেছে এই বিষয়টি নতুন করে ভাবার এবং প্রয়োগের। এর মাধ্যমে ভোটারদের মতামত আরও সঠিকভাবে প্রক্ষেপিত হবে, যেকোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর প্রকৃত জনপ্রিয়তা প্রতিফলিত হবে এবং নির্বাচনী ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে।

আনুপাতিক প্রতিনিধি নির্বাচন ব্যবস্থা রাজনৈতিক বহুত্ববোধকে উৎসাহিত করে, বিভিন্ন গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে এবং দীর্ঘমেয়াদী দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে জোরদার করে। এটি দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি ন্যায়সঙ্গত শাসন প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারে। তাই বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কারে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ভিত্তিক পদ্ধতির গুরুত্ব গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত।

বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও নির্বাচন বিশ্লেষক অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, ``কোনো দল নির্বাচনে যত শতাংশ ভোট পাবে, সংসদে তারা সেই অনুপাতে আসন পাবে, নির্বাচনের এই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি যদি চালু হয় তাহলে তা সুশাসন নিশ্চিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এই পদ্ধতিতে ভোট হলে নিজস্ব ভোট ব্যাংকে কাজে লাগিয়ে বা স্থানীয় ইমেজ কাজে লাগিয়ে কেউ জিতে সরকার গঠন করতে পারে। সেক্ষেত্রে অনেক সময় মেজরিটি ভোটারে মতের প্রতিফলন হয় না। বাংলাদেশের প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থার অসুবিধাগুলো আমরা দেখেছি। আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থার অসুবিধা আমরা দেখিনি। এটা চালু করতে সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে। তবে সেটি খুব কঠিন কিছু নয়।‘’

পিআর পদ্ধতির সুবিধা:

পিআর পদ্ধতিতে ভোটের অনুপাতে আসন বরাদ্দ হয়, ফলে রাজনৈতিক দলগুলো ও সম্প্রদায়গুলো ভোটের অংশের সঠিক প্রতিনিধিত্ব পায়। ছোট দল, সংখ্যালঘু ও বিভিন্ন মতবাদী গোষ্ঠীও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, যা রাজনৈতিক বৈচিত্র্য ও সহিষ্ণুতা বাড়ায়। বিভিন্ন দলকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে সরকার গঠন হয় যা বেশি অংশগ্রহণমূলক ও স্থিতিশীল হয়। ভোটারদের কাছে বিভিন্ন রাজনৈতিক বিকল্প আসা সহজ হয়, ফলে ভোটারদের পছন্দ ও স্বাধীনতা বৃদ্ধি পায়। ভোটের অংশ অনুযায়ী আসন বরাদ্দ হওয়ায় একক দল কর্তৃত্ববাদের প্রবণতা কমে যায়। ভোটাররা মনে করে তাদের ভোট ফেলে দেওয়া হয়নি, ফলে ভোটদানের উৎসাহ বাড়ে। জাতিগত, ধর্মীয় ও সামাজিক সংখ্যালঘুদের স্বতন্ত্রভাবে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ করে দেয়।

সর্বশেষ