‘বেহেশতের পথ অন্যকে নজরদারির মাধ্যমে নয়’

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পোশাক সংক্রান্ত সাম্প্রতিক একটি অফিস আদেশকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে তীব্র আলোচনা ও সমালোচনা। এই বিতর্কে মুখ খুলেছেন অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধনও।
বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) সকালে তিনি ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন, যেখানে নিজের জীবনের নানা পর্যায়ে পোশাক ও সমাজের মূল্যবোধ নিয়ে অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। পোস্টের শিরোনাম ছিল, ‘আমি, আমার পোশাক ও সামাজিক বিচারের মাপকাঠি’।
বাঁধন লেখেন, একসময় তিনি ছিলেন মেধাবী, দয়ালু এবং সমাজের প্রত্যাশানুযায়ী চলা একটি ‘ভদ্র মেয়ে’। বাবা-মা যা বলতেন এবং সমাজ যা ‘শালীন’ মনে করত, তিনি সেটাই পরতেন। কিশোরী অবস্থায় জিন্স পরা থেকে বিরত ছিলেন শুধুমাত্র এই কারণে যে সমাজ তা ‘বাজে মেয়েদের পোশাক’ হিসেবে চিহ্নিত করত।
তিনি জানান, সমাজের চোখে 'পারফেক্ট' মেয়ে হয়ে ওঠার চেষ্টা করলেও জীবনের কঠিন বাস্তবতা এক সময় তাকে ভেঙে দেয়। প্রথম বিবাহে নিপীড়নের শিকার হয়ে পুনর্বাসন কেন্দ্রে পর্যন্ত যেতে হয় তাকে। সেই সময়েই ২০০৬ সালে ‘লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পান, কেবল নারী হিসেবে নয় বরং একজন মানুষ হিসেবে।
তিনি বলেন, তখনও তিনি লাজুক ছিলেন, সত্যবাদী ছিলেন, তবে আস্তে আস্তে আত্মবিশ্বাস ফিরে পান এবং জীবনকে ভালোবাসতে শুরু করেন।
পরবর্তীতে, জিন্স পরা এবং গায়ের রঙ ফুটিয়ে তোলা পোশাক বেছে নেওয়ায় তাকে নানা সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। তিনি বলেন, সমাজে শ্রেষ্ঠ নারী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়েও তাকে বারবার ‘অভদ্র’ পোশাকের জন্য বিচার করা হয়েছে।
দ্বিতীয় বিবাহবিচ্ছেদের পর নিজের ব্যর্থতা এবং সমাজের কঠোর তির্যক দৃষ্টির কথা উল্লেখ করে বাঁধন বলেন, সেই সময়ে তিনি নিজেকে সমাজের চোখে ‘খারাপ নারী’ হিসেবে চিহ্নিত মনে করতেন। তবে সেই ব্যর্থতার ভেতর দিয়েই তিনি সাহসী হয়ে ওঠেন, নিজের অধিকারের জন্য আওয়াজ তোলেন এবং স্বাধীনতার লড়াই শুরু করেন।
একটি ঘটনার কথা জানিয়ে বাঁধন লেখেন, এক বন্ধু তাকে বলেছিল ‘তুমি খুব ভালো করছো, তবে তোমার আরও শালীন পোশাক পরা উচিত।’ জবাবে তিনি কেবল হেসে ফেলেছিলেন।
আরেকটি অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, একবার স্লিভলেস ব্লাউজ পরে টিভি সাক্ষাৎকারে গেলে চ্যানেল টিম তার কাঁধ চুল দিয়ে ঢাকতে বলে এবং তাকে দীর্ঘ লেকচার দেয়। বছরের পর বছর তিনি পোশাক নিয়ে নানা মন্তব্য ও পরামর্শ শুনেছেন একজন মা, নারী, এবং রক্ষণশীল পরিবারের সদস্য হিসেবে।
বাঁধনের কথায়, এখন তিনি আর এসব নিয়ে মাথা ঘামান না। তিনি বলেন, কী পরবেন, কী বলবেন, কী ভাববেন কিংবা কেমন করে বাঁচবেন এ সবই তার নিজের সিদ্ধান্ত।
তিনি বলেন, এই ধরনের বিচার নারীদের প্রতি সমাজের প্রতিদিনকার আচরণ। এ সমাজ নারীদের সংশোধন করাকেই যেন সবচেয়ে বড় লক্ষ্য মনে করে, যেন সেটাই স্বর্গে পৌঁছানোর একমাত্র পথ।
সবশেষে বাঁধন বলেন, যারা এসব বিশ্বাস করে তারা বোকার স্বর্গে বাস করে। বেহেশতের পথ অন্যকে নজরদারির মাধ্যমে নয়, নিজের কাজ ও চিন্তাধারার মাধ্যমেই তৈরি হয় বিশেষ করে নারীদের নিয়ন্ত্রণ করে নয়।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিতর্কিত পোশাক নির্দেশনা ইতোমধ্যেই গভর্নরের নির্দেশে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি পাঠানো হয়।