মার্ক অ্যাঞ্জেলো রিভার অ্যাওয়ার্ড পেলেন ৩ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান

বিশ্ব নদী দিবস ২০২৫ উপলক্ষ্যে রাজধানীর পানি ভবন অডিটোরিয়ামে আজ শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত হলো মার্ক অ্যাঞ্জেলো রিভার অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে আয়োজন করে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ ও সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক মোঃ এনায়েত উল্লাহ।
অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বাংলাদেশের নদীসংক্রান্ত একটি প্রামাণ্যচিত্রও প্রদর্শন করা হয়।
নদী সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় মার্ক অ্যাঞ্জেলো রিভার অ্যাওয়ার্ড ২০২৫ পেয়েছেন দুই জন ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠান। এ বছর গবেষণা ক্যাটাগরিতে মার্ক অ্যাঞ্জেলো রিভার অ্যাওর্য়াড পেয়েছেন হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়কারী প্রফেসর ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া, সাংবাদিকতা ক্যাটাগরিতে দৈনিক সমকালের সিনিয়র রিপোর্টার জাহিদুর রহমান ও সংগঠন ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)। বাপার পক্ষে পুরস্কার গ্রহণ করেন সংগঠনের সভাপতি অধ্যাপক ড. নূর মোহাম্মদ তালুকদার।
অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্যে বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, একটা সময় আমরা বলতে পারতাম না বাংলাদেশে কতগুলো নদী আছে, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের প্রচেষ্টায় আজকে আমরা নদীর সঠিক সংখ্যা জানতে পেরেছি। বর্তমানে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ১৪১৫ টি।
নদী রক্ষার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে মুহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, একটি নদীকে রক্ষা করা মানে হাজারো প্রাণকে রক্ষা করা। নদী বাচঁলেই বাংলাদেশ বাঁচবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নদী বাঁচলে আমাদের সভ্যতা টিকে থাকবে, নদী বাঁচলে আমাদের অর্থনীতি টিকে থাকবে। নদী ছাড়া কোনোটিই সম্ভব না।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পানিসম্পদ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে, জনগণ ঐক্যবদ্ধ হলে এক এবং অভিন্ন উদ্দেশ্যে নদী রক্ষা করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের নদী নিয়ে নানা মতানৈক্য রয়েছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে চলতি বছর পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় নদী কর্মীসহ সকলের সহযোগিতায় নদীর তালিকা করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে ১৪১৫টি নদী রয়েছে। সুন্দরবন এবং পাহাড়ি এলাকার নদী নিয়ে গবেষণা করবে যৌথ নদী কমিশন। যে সকল নদী বাদ পড়েছে সেগুলো যাচাই করে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
এসময় তিনি বলেন, নদী আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে মিশে আছে। আমাদের নিজের স্বার্থে নদী রক্ষা করতে হবে। কিছু নদী আছে সংকটাপন্ন, কিছু আছে আন্ত:সীমান্ত নদী। তিস্তা এবং গঙ্গা নিয়ে বৃহৎ পরিকল্পনার দিকে এগুচ্ছে সরকার।
সৈয়দা রিজওয়ানা বলেন, সেন্টমার্টিন আমাদের জাতীয় সম্পদ, সেন্টমার্টিন বাঁচলে পর্যটন বাঁচবে। তিনি বলেন, সেন্টমার্টিনে পর্যটন কখনোই বন্ধ করা হয় নাই, প্রকৃতি, পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পর্যটন নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
বিশেষ অতিথি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজা বলেন, মার্ক অ্যাঞ্জেলো রিভার অ্যাওয়ার্ড যারা পেয়েছেন তাদের সকলকে প্রানঢালা অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা জানাই মন থেকে। পুরুস্কার পাওয়া দুই ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠানকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি। নদী সংরক্ষণে তারা নির্মোহ ভাবে স্ট্রাগল করে যাচ্ছে।
নদী আন্দোলন নিয়ে মোহাম্মদ এজাজ বলেন, বাংলাদেশের নদী আন্দোলনকে খুব ক্লোজলি ইন্ডিয়া মনিটর করে, বাংলাদেশে যেই নদী আন্দোলন গুলো বেড়ে উঠেছে, সেই নদী আন্দোলনের টাইপগুলো যদি আপনারা লক্ষ্য করেন এবং পরিবেশ আন্দোলনের টাইপ লক্ষ্য করেন, আমরা এক ধরণের ভারতীয় ভাবধারার প্রভাব লক্ষ্য করি। একটা উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, আমাদেরই একজন সহকর্মী, আমাদেরই সহোযোদ্ধা, যিনি তিস্তার পানি, তিস্তার ভাঙন নিয়ে লিখতেন ও বলতেন। তাকে ইন্ডিয়া এমন সুন্দরভাবে সার্জিক্যালি তিস্তা থেকে সরিয়ে দিয়েছে। তিনি এখন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফি করেন। তিস্তা নিয়ে তার লেখা বা ভয়েস আর নাই। এমন না যে উনি বাধ্য হয়েছেন করতে, মেকানিক্যালি একটা লোকের ফোকাসকে চেঞ্জ করে দিয়েছে ইন্ডিয়া।
মোহাম্মদ এজাজ আরো বলেন, ঢাকার ৪ নদী নিয়ে প্ল্যান করা হচ্ছে , ঢাকায় আমি ২টি ছোট নদী উদ্ধার করেছি। আশা করছি নভেম্বর মাসে ছোট নৌ-বিহার অথবা একটা মিছিল করে হলেও উদযাপন করবো।
সভাপতির বক্তব্যে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও ইমপ্রেস গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু সবাইকে নদীপ্রাণ শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘নদী রক্ষার কাজগুলো যখন আমরা সবাই মিলে এগিয়ে নিয়ে যাবো তখন নদী নিয়ে দেশে যে দুরাবস্থা সেটা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারবো। আমরাই এই নদীগুলোকে দূষিত করেছি এবং নদীকে যদি আবার ভালো অবস্থায় নিতে যাই তাহলে আমাদেরই কাজ করতে হবে। সেই কাজটি করতে হলে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রকৃতিবন্ধু মুকিত মজুমদার বাবু বলেন, অনেক সংগঠনের অনেকেই আছেন এখানে, যারা সংগঠনের বাইরে আছেন, পরিবেশ-প্রকৃতি সচেতন তাদের সবাইকে এক হতে হবে নদী রক্ষায়। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ, নদীভিত্তিকই ছিল আমাদের জীবনধারা, সব কিছু ছিল নদী কেন্দ্রীক। অথচ সেই নদীগুলোকে আমরা এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছি যে আজকে আমাদের অস্তিত্বের অংশ নদীকে রক্ষায় দিবস-সভা করতে হচ্ছে। নদী রক্ষায় ব্যয়বহুল পরিকল্পনা করতে হচ্ছে। কারণ নদীকে আমরা যেভাবে কলুষিত করে ফেলেছি তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ব্যাপক প্রচেষ্টা প্রয়োজন, যা বিপুল ব্যয়বহুল, আমাদের মতো দুর্বল অর্থনীতির দেশের জন্য যা সত্যিই চ্যালেঞ্জিং।
তাই আমাদের মাধ্যমে যে নদী দূষণ হচ্ছে তা কমিয়ে আনতে সচেতনতার বিকল্প নেই। সচেতন না হলে নদী দূষণ থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারবো না। যখন আমরা সব রকম দূষণ সম্পর্কে সচেতন হবো, এসব কমিয়ে আনতে সচেতন হয়ে হাতেহাত মেলাবো তখনই সুফল আসবে। সারাদেশে আমাদের এই বার্তা পৌঁছে দিতে হবে যে, এই নদী আমাদের, নদীকে বাঁচানোর দায়িত্বও আমাদের।’
কানাডা থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করেন বিশ্বখ্যাত নদীসংরক্ষক, লেখক ও বক্তা ‘ওয়ার্ল্ড রিভার্স ডে’র প্রতিষ্ঠাতা মার্ক অ্যাঞ্জেলো। আন্তর্জাতিকভাবে নদী রক্ষায় কাজ করা কিংবদন্তি পরিবেশবিদ মার্ক অ্যাঞ্জেলোর অবদান স্মরণ করে ২০২৪ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে মার্ক অ্যাঞ্জেলো রিভার অ্যাওয়ার্ড প্রবর্তন করা হয়।