নীরবে ছড়িয়ে পড়ছে প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগ

প্রাণঘাতী ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামক রোগ মেলিওডোসিস নীরবে ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে। ইতিমধ্যে ১৮টি জেলায় শনাক্ত হওয়া এ রোগটির সংক্রমণ মূলত দেখা যাচ্ছে প্রান্তিক কৃষিজীবীদের মধ্যে, যারা নিয়মিত মাটি ও পানির সংস্পর্শে থাকেন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীর থেকে শ্বাস-প্রশ্বাস বা স্পর্শের মাধ্যমে অন্যদের মধ্যেও এটি ছড়াচ্ছে। রোগটির মৃত্যুহার ৪০ শতাংশেরও বেশি, যা করোনাভাইরাস মহামারিতে দেশের মৃত্যুহারের তুলনায় তিনগুণ। দীর্ঘদিন ধরে রোগটি দেশে বিদ্যমান থাকলেও স্বাস্থ্যখাতের নীতিনির্ধারকদের নজরে আসেনি। ফলে নেই রোগ শনাক্তের পর্যাপ্ত সুবিধা, নেই চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ, আর এর জেরে রোগ নির্ণয়বিহীন চিকিৎসায় প্রাণ হারাচ্ছেন বহু মানুষ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে কোথাও সরকারি পর্যায়ে মেলিওডোসিস শনাক্তের ব্যবস্থা নেই। কেবল ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ এবং আইসিডিডিআর,বি-তে গবেষণার মাধ্যমে এ রোগ শনাক্তের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় রি-এজেন্ট দুষ্প্রাপ্য ও ব্যয়বহুল। ফলে সরকারি উদ্যোগ ছাড়া এটি সর্বসাধারণের নাগালে আনা অসম্ভব।
আইসিডিডিআর,বি-এর গবেষণায় জানা গেছে, মেলিওডোসিস একটি মারাত্মক সংক্রমণ, যা বার্কহোল্ডেরিয়া সিউডোম্যালেই নামক গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ছড়ায়। এই ব্যাকটেরিয়া সাধারণত মাটিতে থাকে এবং ত্বকের সংস্পর্শ, খাওয়ার মাধ্যমে কিংবা শ্বাস-প্রশ্বাসে মানবদেহে প্রবেশ করে। ২০২১ সাল থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে আইসিডিডিআর,বি মোট ৪৬ জন রোগী শনাক্ত করেছে, যাদের মধ্যে ১৪ জনের মৃত্যু হয়। এর আগে ১৯৬১ সাল থেকে দেশে মোট ৮০ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। বর্তমানে ঢাকা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও চট্টগ্রামে সংক্রমণের হার বেশি।
গবেষক ডা. সুকান্ত চৌধুরী জানিয়েছেন, রোগীরা প্রায়ই গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে আসেন, অনেকের ক্ষেত্রেই আইসিইউ প্রয়োজন হয়। আক্রান্তদের বেশিরভাগই কৃষি শ্রমিক, বিশেষ করে বর্ষাকালে, যখন তারা নিয়মিত কাদা ও জলে কাজ করেন। মেলিওডোসিস শনাক্ত করা কঠিন, কারণ এটি নানা উপসর্গে আত্মপ্রকাশ করে। ঢাকার বাইরের অঞ্চলে রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা সীমিত, যা ভুল চিকিৎসা ও মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়।
ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ রোগীর একাধিক স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে, যেমন ডায়াবেটিস (৫০ শতাংশের বেশি), অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি ও ফুসফুসের রোগ, থ্যালাসেমিয়া ও গ্লুকোকোর্টিকয়েড থেরাপি। ব্যাকটেরিয়াটি বহু অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী। অকার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকে চিকিৎসা দিলে মৃত্যুহার ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।
বিশ্বব্যাপী বছরে প্রায় ১ লাখ ৬৫ হাজার মানুষ মেলিওডোসিসে আক্রান্ত হন এবং প্রায় ৮৯ হাজারের মৃত্যু ঘটে। একটি মডেল অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১৬ হাজার ৯৩১ জন রোগী শনাক্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যাদের মধ্যে ৯৫০০ জনের মৃত্যু হতে পারে।
এ রোগে সাধারণত জ্বর, কাশি, বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। শরীরে ফোড়া বা ইনফেকশন তৈরি হয়, ফুসফুস, লিভার, প্লীহা আক্রান্ত হয় এবং শেষ পর্যন্ত রক্তপ্রবাহে সংক্রমণ (সেপ্টিসেমিয়া) দেখা দেয়। দীর্ঘমেয়াদে রোগটি যক্ষ্মার মতো উপসর্গ দেখাতে পারে।
রোগ নির্ণয়ের জন্য রক্ত, পুঁজ বা থুতুর কালচার, বুকের এক্স-রে বা সিটি স্ক্যান প্রয়োজন হয়, তবে এসবের জন্য উন্নত ল্যাব সুবিধা দরকার, যা জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে নেই বললেই চলে। চিকিৎসায় প্রথম ধাপে ১০-১৪ দিন উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক সেবন প্রয়োজন, এরপর ৩-৬ মাসের নির্মূল পর্যায়। ইন্ট্রাভেনাস মেরোপেনেম সবচেয়ে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। তবে এখনো মেলিওডোসিসের কোনো টিকা নেই।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেছেন, রোগটি অত্যন্ত অবহেলিত এবং এখনই ব্যবস্থা না নিলে তা ভয়াবহ মহামারিতে রূপ নিতে পারে। তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে গাইডলাইন প্রণয়ন করে জেলা-উপজেলায় তা পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে চিকিৎসকরা রোগটি সঠিকভাবে শনাক্ত ও চিকিৎসা দিতে পারেন।
সূত্র: কালবেলা