চট্টগ্রামে মেগা প্রকল্পের পরও জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ

চট্টগ্রাম মহানগরীর দীর্ঘদিনের সমস্যা জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সিডিএ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের চারটি প্রকল্পের কাজ ২০১৭ সালে শুরু হয়। ২০২২ সালের মধ্যে সব প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কাজ এগোলেও পরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনার অভাব এবং জনসচেতনতার ঘাটতিতে জলাবদ্ধতা থেকে নগরবাসীর স্থায়ী মুক্তি মিলছে না।
গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে নগরীর নিচু এলাকায় আবারও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। কিছু এলাকায় খাল সংস্কারের ফলে পানি দ্রুত নিষ্কাশিত হলেও চকবাজার, মেহেদীবাগ, কাপাসগোলা, কাতালগঞ্জ, শুলকবহর ও আগ্রাবাদ এলাকাগুলো বরাবরের মতোই পানিতে ডুবে যায়। এতে কয়েক লাখ মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন।
পাহাড়ি এলাকায় পাহাড় ধসের শঙ্কা থাকলেও প্রশাসনের নির্দেশ উপেক্ষা করে কেউ নিরাপদ স্থানে সরে যায়নি। এ অবস্থায় জনজীবন আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, ৩৬টি খাল খননের মধ্যে ২১টির কাজ শেষ হয়েছে। ১২টি খালের মুখে রেগুলেটর ও পাম্প হাউস নির্মাণের মধ্যে চারটি খালে কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, কাজ চলমান থাকায় আগের তুলনায় জলাবদ্ধতা কিছুটা কমেছে। তবে অপচনশীল বর্জ্য খালে পড়ে পানিপ্রবাহ ব্যাহত হওয়ায় নতুন করে জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে।
নগর পরিকল্পনাবিদ দেলোয়ার মজুমদার মনে করেন, পাহাড় মালিকদের জবাবদিহির আওতায় না আনলে পাহাড় ধসে মৃত্যুঝুঁকি থেকেই যাবে। নগরবাসীর অভিযোগ, জলাবদ্ধতার পেছনে বড় কারণ হলো নাগরিকদের অসচেতনতা এবং পরিকল্পনার অভাব। যদিও খরচ হয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ, তবুও বর্ষা এলেই জলাবদ্ধতার আতঙ্কে থাকতে হয়।
গত ১৪ অর্থবছরে তিন মেয়র মিলিয়ে চসিক ব্যয় করেছে প্রায় ৩২৪ কোটি টাকা। নালা-নর্দমা পরিষ্কার, প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণ, খাল খনন ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে এ অর্থ খরচ হলেও সুফল তেমন মিলছে না। বার্ষিক গড় ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় ২৩ কোটি টাকা। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, এই অর্থ পরিকল্পনামাফিক খরচ না হওয়ায় দুর্ভোগ আরও বেড়েছে।
চট্টগ্রামের ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২২টিতে বৃষ্টি ও জোয়ারে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে ১৩টি ওয়ার্ডে বাস করেন প্রায় ১৮ লাখ মানুষ, যারা সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েন। আর ৯টি ওয়ার্ডে জলাবদ্ধতার শিকার প্রায় ১৩ লাখের বেশি মানুষ। সিটি কর্পোরেশনের বাজেট বই বিশ্লেষণে দেখা যায়, সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ব্যয় করেন ৬৬ কোটি টাকা, মোহাম্মদ মনজুর আলম ২০৫ কোটি টাকা এবং আ জ ম নাছির উদ্দীন ৫২ কোটি টাকা। তবে নগরবাসীর প্রশ্ন, এত ব্যয়ে সুফল কোথায়?
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চট্টগ্রাম ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ছাড়া জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। ১৯৯৫ সালে প্রণীত এই পরিকল্পনায় জলাবদ্ধতা নিরসনের কার্যকর দিকনির্দেশনা থাকলেও বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতা প্রকট।
বর্তমানে নগরীতে ১১৮টি খালের দৈর্ঘ্য ১৮২ কিলোমিটার এবং নালা-নর্দমার দৈর্ঘ্য ৭৬৫ কিলোমিটার। অথচ ড্রেনেজ ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিশ্চিত করার মতো বরাদ্দ ও সমন্বয় চরমভাবে অনুপস্থিত। রাজনৈতিক বিবেচনায় কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং অকার্যকর বরাদ্দ ব্যবস্থায় জলাবদ্ধতা নিরসনের উদ্যোগ বারবার ব্যর্থ হচ্ছে।
জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হলো পাহাড় কাটা, খাল ও নালায় ময়লা ফেলা, অবৈধ দখল এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ। নদীর মোহনায় খালের মুখ উঁচু হয়ে যাওয়ায় জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ে, কিন্তু বের হতে না পারায় লোকালয় তলিয়ে যাচ্ছে। ড্রেনেজ এলাকা কমে আসছে এবং জলাশয় ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নালা-নর্দমা ও খালে সেবা সংস্থার পাইপলাইন বাধা সৃষ্টি করছে। অনেকেই এসব স্থানকে ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহার করেন।
সমাধানের জন্য দরকার গবেষণাভিত্তিক পরিকল্পনা এবং সমন্বিত বাস্তবায়ন। কর্ণফুলীর গভীরতা বাড়াতে ড্রেজিং, খাল খনন, ড্রেন প্রশস্তকরণ, জলাধার সংরক্ষণ, ময়লা ব্যবস্থাপনায় কঠোর নজরদারি ও পাইপলাইন অপসারণ জরুরি। সিটি কর্পোরেশনের নেতৃত্বে সব সেবা সংস্থাকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
এ বছর জানুয়ারিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চার উপদেষ্টা জলাবদ্ধতা নিরসনে বিশেষ দায়িত্ব পান এবং চট্টগ্রাম সফর করে আটটি স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা নেন। ইতিমধ্যে খাল ও নালার সংস্কারে কিছুটা সুফল মিলেছে। তবে পুরো নগরী জলাবদ্ধতামুক্ত করতে আরও এক থেকে দেড় বছর সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।