জুমার মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য: সাপ্তাহিক ঈদের দিন

ইসলামের দৃষ্টিতে পবিত্র জুমা এবং তার পূর্ববর্তী রাত ও দিন অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে। জুমার দিনকে সাপ্তাহিক ঈদ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে, কারণ এ দিনের সওয়াব ও মর্যাদা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার সমতুল্য। ইসলামী ইতিহাসেও এই দিনে নানা মহৎ ও গৌরবময় ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
সুরা জুমা পবিত্র কোরআনের ৬২তম সুরা, যা মদিনায় অবতীর্ণ এবং এতে ২ রুকু ও ১১ আয়াত রয়েছে। ‘জুমা’ শব্দের অর্থ ‘জনসমাবেশ’। এই সুরায় আকাশ ও পৃথিবীর আল্লাহর একচ্ছত্র কর্তৃত্বের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। পাশাপাশি ইহুদিদের অন্যায় আচরণ ও মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবী বিধান নিয়ে আলোচনা রয়েছে। জুমার আজান হলে সকলকে কাজ থেকে বিরত হয়ে দ্রুত নামাজে যোগদানের নির্দেশ এবং নামাজ শেষে জীবনের নানা কাজে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
সুরাটির বিশেষ উল্লেখযোগ্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, “হে ইমানদারগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের জন্য ডাকা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং কেনাবেচা ত্যাগ করো। এটাই তোমাদের জন্য সর্বোত্তম, যদি তোমরা জানতে পারো।” (আয়াত ৯)
জুমার দিনে আমল ও নামাজের গুরুত্ব নিয়ে বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। একক দিনে এবং বিশেষ করে জুমার দিনে এর মতো বিস্তারিত বর্ণনা বিরল। যেমন, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, “যে দিন সূর্য উদিত হয়েছে, তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হলো জুমার দিন। এদিন আদম (আ.) সৃষ্টি, জান্নাতে স্থান ও জান্নাত থেকে বের করা হয়।” (সহিহ মুসলিম) আল্লাহ তাআলা জুমার দিনকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন এবং এদিনের সঙ্গে ঐতিহাসিক নানা ঘটনা জড়িত।
সুরাটি মোট তিনটি অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশে (আয়াত ১-৪) আল্লাহর অনুগ্রহ এবং হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর আল-কোরআন নাজিলের বর্ণনা রয়েছে। দ্বিতীয় অংশে (আয়াত ৫-৮) এমন এক জাতির কথা বলা হয়েছে, যারা কিতাবের মর্যাদা দেয়নি এবং মৃত্যুকে অবজ্ঞা করেছে। তৃতীয় অংশে (আয়াত ৯-১১) জুমার দিনে আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিয়ে নামাজে যোগদান ও ব্যবসা ত্যাগের মাধ্যমে সফলতার উপদেশ দেওয়া হয়েছে।
সুরার প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে, আকাশ-পাতালসহ সবকিছু আল্লাহর প্রশংসা করে, যিনি পরাক্রমশালী ও তত্ত্বজ্ঞানী। দ্বিতীয় আয়াতে বর্ণনা আছে, আল্লাহ নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রাসুল (সা.) পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের আল্লাহর আয়াত আবৃত্তি করে উন্নতি সাধন করেন। তৃতীয় আয়াতে বলা হয়েছে, রাসুল (সা.) শুধু তাদের জন্য নয়, যারা এখনো তাদের দলভুক্ত হয়নি, তাদের জন্যও পাঠানো হয়েছে। চতুর্থ আয়াতে আল্লাহর মহা অনুগ্রহের কথা উল্লেখ আছে।
পঞ্চম থেকে অষ্টম আয়াতে ইহুদিদের অনুগমন না করার অবস্থা, মৃত্যুর অনিবার্যতা ও আল্লাহর বিচার সম্পর্কে সতর্কতা দেওয়া হয়েছে। নবম থেকে একাদশ আয়াতে জুমার দিনে আল্লাহর আহ্বানে দ্রুত সাড়া দেওয়ার এবং নামাজ শেষে জীবিকার জন্য ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এখানে আল্লাহকে অধিক স্মরণ করার গুরুত্ব বিশেষভাবে জোর দেয়া হয়েছে।
সাপ্তাহিক জুমার নামাজ আদায় আমাদের কিয়ামতের জমায়েতের প্রতীক, যেখানে আমরা ইচ্ছায় মিলিত হই, আর কিয়ামতের দিন বাধ্যতামূলক জমায়েত হবে। আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে কিতাবের মর্যাদা দিলে সাফল্য লাভ সম্ভব।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, যে ব্যক্তি জুমার দিনে গোসল করে প্রথম মসজিদে পৌঁছায়, তার জন্য একটি উট কোরবানি করার সমমূল্য নেকি রয়েছে। এরপর যাদের আগমন হবে, তাদের নেকিও যথাক্রমে গরু, ছাগল, মুরগি ও ডিম সদকার সমান হবে। ইমাম মিম্বরে বসার পর ফেরেশতারা খুতবা শোনার জন্য বসে যায়। (সহিহ বুখারি: ৮৮১)
আল্লাহ তায়ালা জুমার গুরুত্ব এতই উচ্চ করে কোরআনে আলাদা করে ‘সূরা জুমা’ নাজিল করেছেন। সেখানে ইরশাদ হয়, “হে মুমিনগণ! জুমার দিন যখন নামাজের আহ্বান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে (মসজিদে) এগিয়ে যাও এবং বেচা-কেনা (দুনিয়াবি কাজকর্ম) থেকে বিরত থাকো। এ তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা বুঝো।” (সূরা জুমা: আয়াত ৯)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “মুমিনের জন্য জুমার দিন হলো সাপ্তাহিক ঈদের দিন।” (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১০৯৮) এছাড়াও এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, সূর্য উদিত হওয়া দিনগুলোর মধ্যে জুমার দিনই শ্রেষ্ঠ। এ দিনে আদম (আ.) সৃষ্টি হয়, জান্নাতে প্রবেশ করানো হয় এবং জান্নাত থেকে বের করে দেওয়া হয়। সর্বোপরি, কিয়ামতও এই দিনে ঘটবে। (মুসলিম শরিফ, হাদিস নং ৮৫৪)
মহানবী (সা.) আরো বলছেন, জুমার দিনে এমন একটি সময় থাকে যখন কোনো মুসলিম যদি সেই সময়ে নামাজে থাকে এবং দোয়া করে, তবে আল্লাহ তার যেকোনো কল্যাণ কামনা পূরণ করেন। (বুখারি, হাদিস নং ৬৪০০)
জুমার বিশেষ আমল হিসেবে রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, “তোমরা জুমার দিনে আমার ওপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করো, কারণ তোমাদের পাঠানো দরুদ আমার সামনে পেশ করা হয়।” (আবু দাউদ, হাদিস নং ১০৪৭) তিরমিজি শরিফে বর্ণিত আছে, দরুদ পাঠকারী ব্যক্তির ওপর আল্লাহ দশটি রহমত বর্ষণ করেন।