বুধবার, ০১ অক্টোবর ২০২৫

|১৪ আশ্বিন ১৪৩২

তমাল

প্রকাশিত: ১৮:৫৪, ৪ আগস্ট ২০২৫

কবিরের চোখে বাংলাদেশে নির্বাচন: সমস্যা আর সম্ভাবনা

কবিরের চোখে বাংলাদেশে নির্বাচন: সমস্যা আর সম্ভাবনা
ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

বাংলাদেশের জনগণের কাছে নির্বাচন মানেই শুধু ভোটদানের একটি প্রক্রিয়া নয়; এটি গণতন্ত্রের ভিত্তি, মত প্রকাশের অধিকার, আর ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা নির্ধারণের একটি মঞ্চ। ২০০১ সালের পর থেকে প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে জনমানসে যেমন কৌতূহল, তেমনি উদ্বেগও বিদ্যমান। আসন্ন নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মনের ভিতরে একটাই প্রশ্ন—এই নির্বাচন কি সুষ্ঠু হবে?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমি আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু কবির-এর অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে চাই, যিনি একজন সরকারি চাকরিজীবী এবং চারটি নির্বাচনে (দুইটি জাতীয় সংসদ ও দুইটি সিটি কর্পোরেশন) প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

একটি সিটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা: যখন পুলিশ পাশে ছিল

কবির তার প্রথম দায়িত্ব পালনের সময়ের একটি অভিজ্ঞতা বলেন, যেখানে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় একটি নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। পুলিশ সদস্য বিশেষত কেন্দ্রের এসআই যখন বলেন, "স্যার, আমার মেগাজিনের শেষ গুলি থাকা পর্যন্ত আপনার গায়ে কেউ টাচ করতে পারবে না", তখন তিনি আত্মবিশ্বাস পেয়েছিলেন। ভোট গ্রহণ শেষে সুষ্ঠুভাবে গণনা সম্পন্ন হয় এবং তা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও প্রচারিত হয়েছিল।

তবে হতাশার বিষয় ছিল, পরে জানা যায় ঐ নির্বাচনে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে ভোট বর্জন করেছিল। ফলে সুষ্ঠু ভোটের ফলাফল কোনো রাজনৈতিক তাৎপর্য বহন করেনি। তার অফিসের কয়েকজন সহকর্মী রাজনৈতিক আনুগত্যে ভোটের ফল পরিবর্তন করে দেন। সেখানেই প্রশ্ন জাগে—একটি ভালো নির্বাচনের মানে কী? শুধু কেন্দ্রের ভেতরে ভোটগ্রহণ নয়, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাও কি সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়?

জাতীয় নির্বাচনে বাস্তবতা: যখন পুলিশ নীরব দর্শক

পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে কবিরের অভিজ্ঞতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। যদিও তিনি ইভিএম ভোট গ্রহণে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন, মাঠপর্যায়ে গিয়ে বুঝেছেন প্রযুক্তি নয়, বরং নিরাপত্তা ও নিরপেক্ষতা-ই একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মূল নিয়ামক।

তিনি বলেন, সকাল ৮টা পর্যন্ত ভোট ছিল সুষ্ঠু, এরপর সরকারি দলের লোকজন কেন্দ্র দখল করে নেয়, পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকে। সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারকে আঙুলের ছাপ দিতে বাধ্য করা হয়, না দিলে শারীরিক ক্ষতির হুমকি দেওয়া হয়। স্ট্রাইকিং ফোর্স ডাকলেও আসে না।

এখানে একটা গভীর প্রশ্ন উঠে আসে—শুধু আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি নয়, তাদের নিরপেক্ষ ও কার্যকর ভূমিকা কতটা নিশ্চিত করা যাচ্ছে?

ইভিএমের সুবিধা ও দুর্বলতা: প্রযুক্তি কি সমাধান?

ইভিএম ব্যবস্থার কিছু সুবিধা যেমন—ভুয়া ভোট কঠিন, গণনা সহজ, রাতের ভোটের সম্ভাবনা কম—তা সত্ত্বেও কবিরের মতে, ইভিএম ব্যবহারে নির্বাচন কমিশনের কিছু সিদ্ধান্ত প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশিক্ষণে ২% ভোটারের ক্ষেত্রে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের ছাপ দিয়ে ভোট এক্টিভ করার নিয়ম থাকলেও, ভোটের দিন ১০০% ক্ষেত্রে এ নিয়ম খোলা রাখা হয়েছিল, যা ছিল নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি এক বড় ধরণের আস্থা হানিকর পদক্ষেপ

সমস্যার মূলে কী? কবিরের বিশ্লেষণ ও সুপারিশ

কবিরের অভিমত—মাত্র ৫-৬ জন পুলিশ ও আনসার সদস্য দিয়ে একটি কেন্দ্রে ১০-১২টি কক্ষ নিরাপদ রাখা সম্ভব নয়। সরকারদলীয় লোকজন আনসারের পোশাক পরে কেন্দ্র দখল করে নেয়, আর অস্ত্রহীন আনসার সদস্যরা প্রতিবাদ করতে পারে না। এছাড়া প্রিজাইডিং অফিসারের হাতে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা না থাকলে এবং তা প্রয়োগের সুযোগ না দিলে সুষ্ঠু নির্বাচন কেবল কাগজে-কলমেই থাকে।

তাঁর প্রস্তাবনা:

  • প্রতিটি কেন্দ্রে ৪-৬ জন সশস্ত্র সেনা সদস্য মোতায়েন করা উচিত, যারা কেন্দ্রের গেট ও চারপাশ পাহারা দেবে।

  • ২০-২৫ জন দক্ষ পুলিশ ও আনসার সদস্য থাকতে হবে যারা প্রতিটি বুথে নজরদারি করতে পারবে।

  • স্ট্রাইকিং ফোর্স তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হতে হবে, কেন্দ্র থেকে কল পেলে ১০ মিনিটের মধ্যে উপস্থিত থাকতে হবে।

  • ভোট দুদিনে আয়োজন করা যেতে পারে যাতে নিরাপত্তা বাহিনীর ঘাটতি কাটানো যায়, তবে এর জন্য ফলাফল ব্যবস্থাপনায় বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে।

সুস্থ সংস্কারেই সুষ্ঠু নির্বাচন

আমাদের বাস্তবতা বলছে—শুধু নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি নয়, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, নিরাপত্তা বাহিনীর নিরপেক্ষতা, এবং নির্বাচন কর্মকর্তাদের স্বাধীনতা এই তিনটি জিনিস না থাকলে কোনো প্রযুক্তি বা প্রশিক্ষণই সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারবে না।

অবশ্যই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব—তবে তার জন্য চাই প্রশাসনিক সংস্কার, রাজনৈতিক ঐকমত্য, এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উপযোগী নিরাপত্তা কাঠামো

এইবারের নির্বাচন যদি বিশ্বাসযোগ্য না হয়, তাহলে তার প্রতিক্রিয়া শুধু নির্বাচনী ব্যবস্থায় নয়, দেশের গণতন্ত্র এবং রাষ্ট্রীয় চেতনায়ও পড়বে। এবং সেই চেতনা জুলাইয়ের চেতনা না হয়ে নতুন প্রজন্মের বিভ্রান্তি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ