গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন
যুক্তরাজ্যে হাসিনা-ঘনিষ্ঠ বাংলাদেশিদের সম্পত্তি হস্তান্তরের হিড়িক

বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার একদিকে রাজনৈতিক বিভাজন, অন্যদিকে অর্থনৈতিক সংকট সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এরই মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান এবং বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদের অনুসন্ধান রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তীব্র আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের জাতীয় অপরাধ দমন সংস্থা (এনসিএ) শেখ হাসিনা সরকারের সময় প্রভাবশালী দুই সাবেক মন্ত্রী ও ব্যবসায়ী পরিবারের বিরুদ্ধে বড় ধরনের ব্যবস্থা নেয়। সাবেক এমপি ও ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের পরিবারের ৯০ মিলিয়ন পাউন্ড এবং সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ১৭০ মিলিয়ন পাউন্ডের সম্পত্তি জব্দ করা হয়েছে। অভিযোগ, তারা সরকারি চুক্তি ও ব্যাংক খাতের অপব্যবহারের মাধ্যমে এসব অর্থ পাচার করে যুক্তরাজ্যে বিলাসবহুল টাউনহাউজ ও অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন।
দ্য গার্ডিয়ান ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের যৌথ অনুসন্ধানে জানা যায়, তদন্ত শুরুর পর অনেকে তাদের সম্পত্তি বিক্রি, হস্তান্তর বা পুনঃঅর্থায়নের চেষ্টা করছেন। এনসিএ ইতোমধ্যে এমন কয়েকটি লেনদেন থামিয়ে দিয়েছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে ব্রিটিশ আইন ও পরামর্শ সংস্থাগুলোর সতর্কতা কতটা কার্যকর ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, পাচার হওয়া আরও সম্পত্তি যেন ফ্রিজ করা হয়, এমন আহ্বান জানানো হয়েছে। একই সুরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যান এনসিএকে অনুরোধ করেছেন—নতুন ব্যক্তিদের সম্পদও যেন জব্দ করা হয়।
যুক্তরাজ্যের ভূমি নিবন্ধন কার্যালয়ের তথ্যমতে, গত এক বছরে সন্দেহভাজনদের অন্তত ২০টি সম্পত্তিতে লেনদেনের আবেদন জমা পড়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা হলো, সাইফুজ্জামানের ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী ২০২৩ সালে ১ কোটি পাউন্ডের একটি বিলাসবহুল টাউনহাউস বিক্রি করেন। এছাড়া আরও তিনটি সম্পত্তি পুনঃঅর্থায়নের চেষ্টা চলছে।
অন্যদিকে, সালমান এফ রহমানের ছেলে ও ভাতিজার মালিকানাধীন গ্রোসভেনর স্কয়ারের ৩৫ মিলিয়ন পাউন্ডের একটি অ্যাপার্টমেন্টও এনসিএ ইতোমধ্যে ফ্রিজ করেছে।
দুর্নীতিবিরোধী এই অভিযানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগও উঠেছে। রহমান পরিবারের আইনজীবীরা দাবি করছেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো অনিয়ম নেই এবং তারা যেকোনো তদন্তে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের এমপি জো পাওয়েল মন্তব্য করেছেন, তদন্তাধীন ব্যক্তিদের সম্পদ ফ্রিজ না করলে তা সহজেই 'অদৃশ্য' হয়ে যেতে পারে। তিনি এনসিএর পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে আরও জোরালো পদক্ষেপের আহ্বান জানান।
এই অভিযান লন্ডনের আইন প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতে, যখন ক্লায়েন্ট তদন্তাধীন, তখন পেশাদারদের উচিত হয় যথাযথ সতর্কতা নেওয়া, নয়তো এই অর্থ আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থায় হারিয়ে যেতে পারে—ফেরত আনা হবে প্রায় অসম্ভব।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি লন্ডন সফর করেন, যেখানে ইউকে সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার এবং সম্পদ পুনরুদ্ধারের বিষয়ে আলোচনা হয়।
বিশ্লেষকদের মতে, এই অভিযান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক পর্ব হতে চলেছে। যেখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বাস্তব পদক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক সহায়তার সমন্বয়ে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন হতে পারে। তবে তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ না করে, ন্যায়ের ভিত্তিতে পরিচালিত হতে হবে, এমনটাই প্রত্যাশা দেশের সচেতন নাগরিকদের।