বুধবার, ০১ অক্টোবর ২০২৫

|১৪ আশ্বিন ১৪৩২

আল জাজিরার এক্সপ্লেইনার

প্রকাশিত: ১৩:৩৬, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

‘সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন’; ভারতে লাদাখে জেন-জির বিক্ষোভে নিহত ৪

‘সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন’; ভারতে লাদাখে জেন-জির বিক্ষোভে নিহত ৪
ছবি: আল জাজিরা

হিমালয়ের উচ্চভূমির শীতল মরুভূমি লাদাখ, যা সাম্প্রতিক ভারত-চীন উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু, বুধবার জেনারেশন জেড-নেতৃত্বাধীন সহিংস বিক্ষোভে কেঁপে ওঠে। বিক্ষোভকারীরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আঞ্চলিক কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করে।

লে শহরে (লাদাখের আঞ্চলিক রাজধানী) ছাত্র-তরুণসহ বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে অন্তত চারজন নিহত এবং ডজনাধিক আহত হয়েছেন বলে বিক্ষোভ সমন্বয়কারীরা আল জাজিরাকে জানিয়েছেন। অতিরিক্ত সেনা মোতায়েনের পর এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সংঘর্ষে নিরাপত্তা বাহিনীরও ডজনাধিক সদস্য আহত হয়েছেন।

গত ছয় বছর ধরে লাদাখের স্থানীয় সিভিল সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে হাজারো মানুষ সাংবিধানিক সুরক্ষা ও পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদার দাবিতে শান্তিপূর্ণ মিছিল ও অনশন কর্মসূচি চালিয়ে আসছিলেন। তাদের দাবি, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে।

তবে বুধবার হতাশ তরুণদের একাংশ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ থেকে সরে গিয়ে সহিংস পথে হাঁটে। লাদাখের পরিচিত শিক্ষাবিদ ও অনশন আন্দোলনের নেতা সোনম ওয়াংচুক এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘এটি ছিল তরুণদের বিস্ফোরণ এক ধরনের জেন জেড বিপ্লব, যা তাদের রাস্তায় নামিয়ে এনেছে।’ তিনি এ মাসের শুরুর দিকে নেপালে ঘটে যাওয়া তরুণ-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করেন, যা শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির পতন ঘটায়।

সংঘর্ষের সূত্রপাত কীভাবে?

বুধবার সকালে লাদাখ অ্যাপেক্স বডির নেতৃত্বে স্থানীয়দের অনশন আন্দোলন ১৫তম দিনে পৌঁছায়। আগের দিন সন্ধ্যায় দুজন অনশনকারী (বয়স ৬২ ও ৭১) হাসপাতালে ভর্তি হন। এ ঘটনায় সংগঠকরা স্থানীয় ধর্মঘটের ডাক দেন। একইসঙ্গে মোদি সরকারের টালবাহানায় আলোচনায় দেরি হওয়ায় বিক্ষোভকারীদের ক্ষোভ তীব্র হয়।

এরপর হতাশ তরুণদের একটি দল লে শহরের শহীদ স্মৃতিসৌধ থেকে সরে গিয়ে সরকারি কার্যালয় ও বিজেপি অফিসের দিকে অগ্রসর হয় এবং স্লোগান দিতে থাকে। এসময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে চারজন নিহত হন, একজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছেন এবং ডজনাধিক আহত হন।

লাদাখ অ্যাপেক্স বডির সমন্বয়ক জিগমাত পালজোর বলেন, ‘এটি লাদাখের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন। তারা আমাদের তরুণদের শহীদ করেছে সাধারণ মানুষকে, যারা কেবল দাবি সমর্থনে রাস্তায় নেমেছিল।’ তিনি অভিযোগ করেন, সরকারের ‘পাঁচ বছরের ভুয়া প্রতিশ্রুতিতে মানুষ বিরক্ত’ হয়ে এ সহিংস বিস্ফোরণ ঘটেছে। সহিংসতার প্রেক্ষাপটে অ্যাপেক্স বডি অনশন কর্মসূচি স্থগিত করে শান্তির আহ্বান জানায়।

ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, উচ্ছৃঙ্খল ভিড়ের সঙ্গে সংঘর্ষে ৩০-এর বেশি নিরাপত্তা সদস্য আহত হয়েছেন এবং আত্মরক্ষার্থে পুলিশকে গুলি চালাতে হয়েছে, যাতে কিছু হতাহতের ঘটনা ঘটে। মন্ত্রণালয় আরও অভিযোগ করে, ওয়াংচুক অ্যারাব স্প্রিং ধাঁচের বিক্ষোভ এবং নেপালের তরুণদের আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে লোকজনকে উসকে দিয়েছেন। তবে ওয়াংচুক বরাবরই দাবি করে আসছেন, তিনি কখনো সহিংসতার পক্ষে নন, বরং সতর্ক করেছিলেন যে সরকারের উদাসীনতায় তরুণদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারে।

বিক্ষোভকারীদের দাবি কী?

২০১৯ সালে মোদি সরকার জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ও রাজ্যের অধিকার বাতিল করে অঞ্চলটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করে। জম্মু ও কাশ্মীরকে সীমিত আইনসভার ক্ষমতা দেওয়া হলেও লাদাখ সরাসরি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে থাকে, যেখানে জনগণের কোনো নির্বাচিত স্থানীয় প্রতিনিধি নেই।

প্রায় ৯০ শতাংশ লাদাখি জনগোষ্ঠী অনূসুচিত উপজাতিভুক্ত। তাই তাদের দাবি—ভারতের সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় লাদাখকে আনা হোক, যাতে স্থানীয় জনগোষ্ঠী স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসন ও সাংবিধানিক সুরক্ষা পায়। বর্তমানে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ১০টি এলাকা এ তফসিলের আওতায় রয়েছে।

এছাড়া, রাজ্য বিভক্তির পর লাদাখিরা কর্মসংস্থান সংকটে পড়েছেন। পূর্বে জম্মু-কাশ্মীরে যে চাকরির সুযোগ ছিল, তা হারিয়ে ফেলেছেন। ২০২৩ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, লাদাখের ২৬.৫ শতাংশ স্নাতক বেকার যা জাতীয় গড়ের দ্বিগুণ।

ওয়াংচুক বলেন, ‘পাঁচ বছর ধরে তরুণরা বেকার। তাদের সাংবিধানিক সুরক্ষাও দেওয়া হয়নি। এটাই সামাজিক অস্থিরতার রেসিপি।’

আগের বিক্ষোভ

লাদাখে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ নতুন নয়। বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর থেকেই স্থানীয় নাগরিক সংগঠনগুলো মিছিল ও অনশন চালিয়ে আসছে। ওয়াংচুক একাই গত তিন বছরে পাঁচবার অনশন করেছেন। লাদাখের তিন তরুণকে স্মরণে নির্মিত শহীদ স্মৃতিসৌধেই এ কর্মসূচি হয়, যেখানে ১৯৮৯ সালের এক বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে তারা নিহত হয়েছিলেন।

তবে বুধবারের ঘটনা লাদাখের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী দিন হিসেবে চিহ্নিত হলো।

সিভিল সদস্য সাজাদ কারগিলি বলেন, ‘লাদাখের সহিংসতা আমাদের তরুণদের হতাশার প্রতিফলন। সরকারকে বুঝতে হবে, এখানে তরুণরা আছে যারা অনশনে বসতে রাজি নয়—তারা ক্ষুব্ধ হয়ে অন্য পথে যাচ্ছে। মোদি সরকার এ আহ্বান অগ্রাহ্য করতে পারে না।’

কৌশলগত গুরুত্ব

লাদাখ ভারতের উত্তর সীমানায় চীন-সীমান্তবর্তী এলাকা। এখানে গুরুত্বপূর্ণ পর্বতপথ, বিমানঘাঁটি ও সরবরাহপথ রয়েছে, যা ভারতীয় সেনার জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত জরুরি। ২০২০ সালে লাদাখে ভারত-চীন সেনাদের সংঘর্ষে ২০ ভারতীয় ও চার চীনা সেনা নিহত হয়। এরপর দুই পক্ষই হাজার হাজার সেনা ও ভারী অস্ত্র মোতায়েন করে।

যদিও সাম্প্রতিক কূটনৈতিক আলোচনায় সীমান্ত উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হয়েছে, বিশ্লেষক সিদ্দিক ওয়াহিদের মতে, ২০১৯ সালের সিদ্ধান্ত এখন অভ্যন্তরীণ সংকটে রূপ নিচ্ছে। তিনি বলেন, ‘কেন্দ্র সরকার এতদিন কাশ্মীরকে অস্থিরতার কেন্দ্র হিসেবে সামলাত। এখন লাদাখও সেই তালিকায় যুক্ত হলো।’
 

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ