তিন মাস ধরে কমছে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি, অক্টোবরে কমেছে ৭.৪৩ শতাংশ
দেশে সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে শ্লথগতির মধ্যেও কিছুটা স্বস্তি ছিল রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সে। কিন্তু চলতি অর্থবছরের চার মাস পর রপ্তানি খাতের সাফল্য ফিকে হয়ে এসেছে। টানা তিন মাস ধরে রপ্তানি আয় কমছে। বিশেষ করে অক্টোবরে দেশের রপ্তানি আয়ে ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ পতন ঘটেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে গতকাল প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্য বলছে, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের অক্টোবরে দেশ থেকে ৩৮২ কোটি ৩৯ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। যেখানে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একই মাসে ৪১৩ কোটি ৮ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। সে হিসাবে গত মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি কমেছে ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এর আগে সেপ্টেম্বর ও আগস্টেও রপ্তানি কমেছে।
সেপ্টেম্বরে রপ্তানি কমার হার ছিল ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ। আর আগস্টে কমেছিল ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ। গত বছরের জুলাইয়ের তুলনায় চলতি বছরের জুলাইয়ে রপ্তানি খাতে ২৪ দশমিক ৯০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এই এক মাসের বড় প্রবৃদ্ধির প্রভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাস শেষে (জুলাই-অক্টোবর) এ খাতে প্রবৃদ্ধির ধারা দেখাচ্ছে। তবে রপ্তানি খাতে অর্থবছরের শুরুতে প্রায় ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও চার মাস পরে এসে তা মাত্র ২ দশমিক ২২ শতাংশে ঠেকেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৪ সালের জুলাইয়ের বেশির ভাগ সময় ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে সারা দেশ উত্তাল ছিল। সড়ক অবরোধ, সংঘাত-সংঘর্ষ, কারফিউসহ শেখ হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরোপুরি স্থবির হয়ে গিয়েছিল। তার পরও সে মাসে ৩৮২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। বিপরীতে গত তিন মাসে (আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর) দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অনেকটাই স্থিতিশীল।এর পরও গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি আয় না বেড়ে উল্টো কমে যাওয়াটি উদ্বেগজনক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ ইস্যুতে জুলাই ও আগস্টে আমাদের রপ্তানি খাত কিছুটা চাপে ছিল। সেটির প্রভাব সেপ্টেম্বরেও কিছুটা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু অক্টোবরে এসে আমাদের রপ্তানি এতটা কমে যাওয়া অবশ্যই অ্যালার্মিং। এ বিষয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকদের সতর্ক হওয়া দরকার।’
রাইজিং ফ্যাশনস লিমিটেডের এ ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘গত বছরের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে দেশে রপ্তানিমুখী অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়ায় অনেক উদ্যোক্তা কাঁচামাল আমদানি করতে পারছেন না। ব্যাংক ঋণের সুদহারও প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে ব্যবসা পরিচালনা করা খুবই কঠিন।’
ইপিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বাংলাদেশ থেকে বিশ্ববাজারে রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ৬১৩ কোটি ৭০ লাখ ৩০ হাজার ডলারের পণ্য। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একই সময়ে ১ হাজার ৫৭৮ কোটি ৬৩ লাখ ২০ হাজার ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। এ হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে বা পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ২ দশমিক ২২ শতাংশ। সংস্থাটির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত পাঁচ অর্থবছরের মধ্যে রপ্তানি খাতে এটি দ্বিতীয় সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি। মূলত ধারাবাহিকভাবে গত তিন মাসে রপ্তানি কমে যাওয়ার প্রভাবে প্রবৃদ্ধিতে এই খরা।
গত বছরের আগস্টে দেশের রপ্তানি ছিল ৪০৩ কোটি ৩২ লাখ ডলার। চলতি বছরের একই মাসে ৩৯১ কোটি ৫০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। সে হিসাবে আগস্টে রপ্তানি কমেছে ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে রপ্তানি হয় ৩৮০ কোটি ২৯ লাখ ডলারের পণ্য। চলতি বছরের একই মাসে এ রপ্তানি ৩৬২ কোটি ৭৬ লাখ ডলারে নেমে গেছে। রপ্তানি কমেছে ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ। আর অক্টোবরে এসে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ কমেছে। গত বছরের অক্টোবরে ৪১৩ কোটি ৮ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হলেও চলতি বছরের একই সময়ে ৩৮২ কোটি ৩৯ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
দেশের রপ্তানি খাতের প্রধান পণ্য তৈরি পোশাক, যা মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশেরও বেশি। ফলে এ পণ্যের রপ্তানির গতিপ্রকৃতি সার্বিক রপ্তানিতে প্রভাব ফেলে। প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পেছনে তৈরি পোশাক খাতের ভূমিকাই বেশি বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। ইপিবির পরিসংখ্যানেও বিষয়টি উঠে এসেছে। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ কমে গেছে।
তৈরি পোশাকের বেশির ভাগ ক্রেতাই নতুন করে কোনো অর্ডার দিচ্ছেন না বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেছেন, ‘দেশের শিল্প ও অর্থনীতি এখন আইসিইউতে রয়েছে। ৮০ শতাংশ কারখানা এখন লোকসানে চলছে। ক্রেতাদের কাছ থেকে নতুন ক্রয়াদেশ পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থার মধ্যেও সরকার এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পথে রয়েছে। অথচ আমরা শুরু থেকেই সরকারকে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পিছিয়ে দেয়ার জন্য বলে আসছি। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হলে দেশের রপ্তানি খাত আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
দেশের তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানির সঙ্গে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির (ঋণপত্র) নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এ ধরনের এলসি খোলা ১০ দশমিক ৬৩ শতাংশ কমেছে। একইভাবে কমেছে শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি, মধ্যবর্তী পণ্য ও কাঁচামাল আমদানির এলসি নিষ্পত্তিও। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে মূলধনি যন্ত্রপাতির এলসি নিষ্পত্তি ১১ শতাংশ কমেছে। এর আগে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিল্পের প্রধান এ উপকরণ আমদানি কমেছিল ২৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য ও কাঁচামাল আমদানির এলসি নিষ্পত্তি কমেছে যথাক্রমে ১৭ দশমিক ৬২ ও ১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ।
দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি এখন গত দুই দশকের বেশি সময়ের মধ্যে কম। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি বছরের জুনেই দেশের বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি ইতিহাসের সর্বনিম্নে নেমে এসেছিল। আর জুলাই ও আগস্টে প্রবৃদ্ধি নয়, বরং বেসরকারি খাতের ঋণ স্থিতি ঋণাত্মক ধারায় চলে যায়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ মাস তথা জুনে বেসরকারি খাতে ঋণ স্থিতি ছিল ১৭ লাখ ৪৭ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের আগস্টে এসে এ ঋণ স্থিতি ১৭ লাখ ৪৭ হাজার ৯৪ কোটি টাকায় নেমে আসে। সে হিসাবে অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ঋণ প্রবৃদ্ধি না হয়ে বরং ঋণাত্মক ধারায় নেমে গিয়েছিল। তবে সেপ্টেম্বরে এসে এ ঋণ যৎসামান্য বেড়েছে।
ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, ব্যাংকগুলো সে অর্থে নতুন কোনো ঋণই বিতরণ করছে না। বার্ষিক ভিত্তিতে ঋণের যে প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, সেটিও অনাদায়ী সুদ ও সুদহার বৃদ্ধির প্রভাব থেকে এসেছে। বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে এতটা খরা এর আগে দেখা যায়নি। যদিও দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস হলো বেসরকারি খাত। পণ্য উৎপাদন, বিপণন কিংবা সেবা খাতের বড় অংশ বেসরকারি উদ্যোগনির্ভর। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও ঋণপ্রবাহ বাড়ানো সম্ভব না হলে দেশের অর্থনীতিতে গতি ফিরবে না।
ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দিচ্ছে না, উদ্যোক্তারাও নিচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বেশির ভাগ ব্যাংক ঋণ শুরু হয় আমদানির এলসি খোলা থেকে। গত দুই বছর আমদানি পরিস্থিতি ভালো নেই। মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি পরিস্থিতি খুবই খারাপ। ব্যাংকগুলো সে অর্থে নতুন কোনো ঋণই দিচ্ছে না। ব্যাংকাররা এখন ঋণ না দিয়ে সরকারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগকে বেশি নিরাপদ ও লাভজনক মনে করছেন। এ কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ স্থিতি ঋণাত্মক ধারায় চলে গেছে।’
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান আরো বলেন, ‘গত দেড় দশকে বেসরকারি খাতে যে উচ্চ ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল সেটিও অস্বাভাবিক। জালজালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ঋণ বের করে নেয়া হয়েছে। যে ১১-১২টি বেসরকারি ব্যাংক থেকে অস্বাভাবিক মাত্রায় ঋণ বের হতো, সেগুলো এখন পঙ্গু। পাঁচটি ব্যাংক এখন একীভূত হওয়ার পথে। এ ব্যাংকগুলোর ১ টাকা ঋণ দেয়ার সক্ষমতাও নেই। এ পরিস্থিতিতে ঋণ প্রবৃদ্ধি না হওয়াটিই বরং স্বাভাবিক।’
সূত্র : বণিক বার্তা



























