এসএসসি ফলাফল: ‘খাতা দেখার উদার নীতি’ না থাকায় ‘ফল বিপর্যয়’

‘খাতা দেখার উদার নীতি’ থেকে সরে আসার কারণে এবার মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মেধার চেহারা সামনে এসেছে। এই একটি সিদ্ধান্তেই উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে পাসের হার এবং জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা। গত ১৫ বছরে এত খারাপ ফল আর হয়নি।
দীর্ঘদিন ধরেই পাবলিক পরীক্ষায় উদার মূল্যায়ন নীতির কারণে ফলাফলের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। সরকার এবার সে নীতিতে পরিবর্তন এনে ‘সহানুভূতির নম্বর’ বা অতিরিক্ত নম্বর প্রদানের প্রথা বন্ধ করেছে। ফলে ২৮ পেলে ৩৩ করে পাস করিয়ে দেওয়া বা ভুল উত্তরেও নম্বর দেওয়ার অলিখিত নিয়ম আর নেই।
এ সিদ্ধান্তের প্রভাব প্রথম দেখা গেছে এবারের এসএসসি পরীক্ষায়। ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সব বোর্ডেই গণিতে পাসের হার আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় গণিতে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর হার বেশি। একই সঙ্গে শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে, আর শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে।
শহর ও গ্রামের মধ্যে বৈষম্যও বেড়েছে। ঢাকা শহরে পাসের হার ৮০ শতাংশের বেশি হলেও একই বোর্ডের টাঙ্গাইলে তা ৬৩ শতাংশ এবং মুন্সীগঞ্জে ৬৭ শতাংশ। মানবিক শাখার শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি পিছিয়েছে।
ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দোকার এহসানুল কবির জানিয়েছেন, এবার কেউ গ্রেস মার্ক পায়নি। কোনো ধরনের চাপ ছাড়াই উত্তরপত্র যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে।
২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় ১৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ কম। পূর্ণ জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন, যা গত বছরের তুলনায় ৪৩ হাজার ৯৭ জন কম।
ফল বিশ্লেষণে জানা গেছে, গণিতের ব্যর্থতাই মূল ধাক্কা দিয়েছে। ১১টি বোর্ডের মধ্যে সবচেয়ে ভালো করেছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড (৮৮.৭২ শতাংশ)। ঢাকা বোর্ডে গণিতে পাস করেছে ৭৫.১৪ শতাংশ, রাজশাহীতে ৮৬.৫২, যশোরে ৮৫.০২, চট্টগ্রামে ৮১.৫৩, সিলেটে ৮৩.১৭ শতাংশ। সবচেয়ে খারাপ ফল বরিশাল ও ময়মনসিংহে; বরিশালে ৬৪.৬২ ও ময়মনসিংহে ৬৪.২৭ শতাংশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গণিত নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এখনও ভয় কাজ করে। শিক্ষক সংকট, মানসম্মত পাঠদানের অভাব, পর্যাপ্ত অনুশীলনের ঘাটতি, পাঠ্যবই নয়, গাইড ও কোচিং নির্ভরতা এর অন্যতম কারণ।
বরিশাল বোর্ড ফলাফলের দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে। ইংরেজি ও গণিত– দুই বিষয়েই এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। ইংরেজিতে সেখানে পাসের হার ৬৯.৬৬ শতাংশ।
মোট ৬ লাখ ৬৬০ শিক্ষার্থী এবার অকৃতকার্য হয়েছে। এর মধ্যে ৩ লাখ ২৪ হাজার ৭১৬ জন ছাত্র এবং ২ লাখ ৭৫ হাজার ৯৪৪ জন ছাত্রী। ১৩৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষার্থীও পাস করেনি।
পাসের হারে এবারও মেয়েরা এগিয়ে। ছাত্রীরা পাস করেছে ৭১.০৩ শতাংশ, ছেলেরা ৬৫.৮৮ শতাংশ। টানা ১০ বছর মেয়েরাই এগিয়ে আছে পাসের হারে।
বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানরা ব্যর্থতার জন্য দায়ী করেছেন গণিত ও ইংরেজিতে দুর্বলতা, কোচিং নির্ভরতা এবং গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার মানোন্নয়নের অভাবকে।
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু এ ফলাফলকে ‘ফল বিপর্যয়’ বলে অভিহিত করেছেন এবং শিক্ষার মানোন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সূত্র: সমকাল