গোপালগঞ্জের ঘটনায় ৯ শিশুসহ কারাগারে ২৭৭

গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৭৭ জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। জেলা কারাগারে স্থান সংকুলান না থাকায় ১৭৭ জনকে সেখানেই রাখা হয়েছে, আর বাকি ১০০ জনকে শনিবার পাঠানো হয় পিরোজপুর ও বাগেরহাট কারাগারে। গ্রেপ্তারদের মধ্যে অন্তত ৯ শিশু রয়েছে, যাদের যশোরের পুলেরহাট শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হবে বলে জানা গেছে।
এনসিপির পদযাত্রায় বাধা ও দুটি মোটরসাইকেল পোড়ানোর ঘটনায় আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের ৫৪ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করে এবং আরও ৩০০-৩৫০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে নতুন একটি মামলা হয়েছে। শুক্রবার রাতে গোপালগঞ্জ সদর থানায় বৌলতলী পুলিশ ফাঁড়ির এসআই শামীম আল মামুন এই মামলা দায়ের করেন। এ নিয়ে মোট মামলা হলো চারটি, যেখানে আসামির সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। নতুন করে আরও ১১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
শনিবার দিনভর আটক ব্যক্তিদের স্বজনদের ভিড় ছিল জেলা কারাগার ও সদর থানার সামনে। কেউ বন্দির জন্য খাবার, টাকা ও কাপড় দিয়ে গেছেন, কেউ আবার জানতে পেরেছেন, তাদের স্বজনকে অন্য জেলায় পাঠানো হয়েছে। থানার সামনে নতুন করে আটকদের খোঁজে এসেছেন আরও অনেক স্বজন, যাদের দাবি—আটকের সময় তাদের পরিবারের সদস্যরা ঘটনাস্থলে ছিলেন না এবং রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত নন।
গত ১৬ জুলাই এনসিপির পদযাত্রা ও পথসভা ভণ্ডুল করতে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। এরপর তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ওইদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে চারজন নিহত হন এবং পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় পুলিশ ও সাংবাদিকসহ শতাধিক ব্যক্তি আহত হন।
নিহতের ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি। গোপালগঞ্জ সদর থানার ওসি মীর মোহাম্মদ সাজেদুর রহমান জানান, পাঁচ মৃত্যুর ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে এবং শনিবার রাতেই মামলার কার্যক্রম শুরু হবে।
আটকদের স্বজনদের অভিযোগে উঠে আসে, অনেকেই সংঘর্ষের সময় উপস্থিত ছিলেন না। মোজাম্মেল শেখ জানান, তার ১৬ বছর বয়সী ভাইপো আসিফ মোল্লা বিসিক এলাকায় বেকারিতে কাজ করেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে খালে গোসল করতে গিয়ে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। প্রিন্স অধিকারী নামে এক কিশোর, যিনি বাসায় থেকে এসএসসি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তাকেও বাসার সামনে থেকে আটক করা হয়েছে বলে জানান তার বাবা-মা।
রিফাত বিশ্বাস নামে এক তরুণ, যিনি মামার দোকানে কাজ করেন, তাকেও বৃহস্পতিবার রাতে দোকান বন্ধ করে বাসায় ফেরার সময় আটক করা হয়। মালয়েশিয়া প্রবাসী আবু দাউদ, যিনি ঈদের ছুটিতে দেশে ফিরেছেন, তাকেও রাত ১০টার দিকে বাসার কাছ থেকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। তার মা বলেন, তিনি মাদ্রাসায় হাফেজি পড়েছেন এবং নিয়মিত নামাজ পড়েন।
জেলার কারাফটকের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। কারারক্ষী রিপন শেখ জানান, বুধবারের হামলার পর আপাতত বন্দিদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না।
সদরের বোয়ালিয়া হাটের ব্যবসায়ী মামুন শেখকে দোকান থেকে আটক করা হয়েছে বলে জানান তার ভাই তরিকুল ইসলাম। বিনতা ভৌমিক জানান, তার ছেলে রাজমিস্ত্রি সুমন ভৌমিককে শনিবার সকালে বাজার থেকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। মাহিন্দ্র চালক তুফান সিকদারকে পাম্পে তেল নিতে গিয়ে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তার মামা।
চারটি মামলায় মোট আসামির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩,০০৮ জন। এর মধ্যে গোপালগঞ্জ সদর থানায় দুটি, কোটালীপাড়া থানায় একটি এবং কাশিয়ানী থানায় একটি মামলা হয়েছে। সদর থানার মামলায় ৪০৪ জন, অপর মামলায় ৫৭৫ জন, কোটালীপাড়ায় ১,৬৫৫ জন এবং কাশিয়ানীতে ৩৭৪ জনকে আসামি করা হয়েছে।
জেলার পাঁচ থানার গ্রেপ্তারকৃত ২৭৭ জনকে গোপালগঞ্জ সিজেএম আদালতে হাজির করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। জেলার তানিয়া জামান জানান, শুক্রবার ১৬৭ জন এবং শনিবার ১১০ জন বন্দিকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। শুক্রবার কারাগারে আসা ৫০ জনকে পিরোজপুর এবং ৫০ জনকে মাদারীপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে। গ্রেপ্তারদের মধ্যে অন্তত নয়জন শিশু রয়েছে, যাদের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হবে।
গোপালগঞ্জে শনিবার রাত ৮টা থেকে রোববার সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়েছিল। এরপর জেলা প্রশাসন রোববার সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাসেল মুন্সি জানান, কারফিউ শেষে ১৪৪ ধারা কার্যকর হয়েছে।
শনিবার কারফিউ শিথিল থাকলেও শহরে লোকজনের উপস্থিতি ছিল কম। যানবাহন ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম সীমিত ছিল। হরিদাসপুরের ইজিবাইক চালক আরিফুল ইসলাম বলেন, রাস্তায় যাত্রী নেই। সাধারণত দিনে ৭০০-৮০০ টাকা আয় করলেও গত তিন দিনে আয় হয়েছে মাত্র ২০০-৩০০ টাকা। বড় বাজারের চাল ব্যবসায়ী অনুপ সাহা বলেন, তিন দিন পর দোকান খুলেছেন, তবে দুপুরের আগেই বাজার ফাঁকা হয়ে যাওয়ায় দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন।