ব্রিটিশ তথ্য ফাঁস, যুক্তরাজ্যে গোপন কর্মসূচিতে হাজার হাজার আফগান পুনর্বাসন

একজন ব্রিটিশ কর্মকর্তার অনিচ্ছাকৃত ভুলে আফগান আশ্রয়প্রার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হওয়ার পর, গোপন এক পরিকল্পনার আওতায় হাজার হাজার আফগানকে যুক্তরাজ্যে নিয়ে আসা হয়, এখন তা প্রকাশ্যে এসেছে। খবর! বিবিসি।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর যুক্তরাজ্যে আশ্রয়ের আবেদনকারীদের মধ্যে প্রায় ১৯,০০০ জনের তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। এই ঘটনা ২০২৩ সালের আগস্টে সামনে আসে, যখন ফাঁস হওয়া কিছু তথ্য ফেসবুকে প্রকাশিত হয়।
তথ্য ফাঁসের প্রায় নয় মাস পর শুরু হয় নতুন এক পুনর্বাসন প্রকল্প, যার আওতায় এখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে পৌঁছেছেন সাড়ে চার হাজার আফগান। পুরো ঘটনা গোপন রাখতে সরকার সুপার-ইনজাংকশন জারি করেছিল, যার মাধ্যমে তথ্য ফাঁস সংক্রান্ত যেকোনো খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ নিষিদ্ধ ছিল।
হাইকোর্টের বিচারক এই নিষেধাজ্ঞা সম্প্রতি প্রত্যাহার করলে বিষয়টি জনসমক্ষে আসে। ফাঁসের জন্য দায়ী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি ডাউনিং স্ট্রিট।
সরকার জানিয়েছে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এখনও আফগানিস্তানে অবস্থান করছেন ফাঁস হওয়া তালিকায় থাকা ৬০০ সেনা সদস্য এবং তাদের ১,৮০০ স্বজন। যদিও কর্মসূচিটি বন্ধ করা হচ্ছে, সরকার প্রতিশ্রুত পুনর্বাসন বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে।
এই গোপন প্রকল্পের নাম ছিল ‘আফগান রিলোকেশন রুট’। এতে এখন পর্যন্ত ৪০০ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ হয়েছে, ভবিষ্যতে ব্যয় দাঁড়াতে পারে আরও ৪০০ থেকে ৪৫০ মিলিয়ন পাউন্ড পর্যন্ত।
যাঁদের তথ্য ফাঁস হয়েছিল, তাঁদের মঙ্গলবার বিষয়টি জানানো হয়। প্রতিরক্ষা সচিব জন হিলি হাউস অব কমন্সে তাঁদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে জানান, একটি স্প্রেডশিট সরকারি অনুমোদনের বাইরে ইমেইল করাই এই ঘটনা ঘটায়। তিনি একে ‘গুরুতর প্রশাসনিক ব্যর্থতা’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
মেট্রোপলিটন পুলিশ তদন্তের মতো যথেষ্ট প্রমাণ পায়নি। হিলি জানান, এটি ছিল আফগানিস্তান থেকে লোক সরানোর সময় ঘটে যাওয়া একাধিক তথ্য ফাঁসের একটি উদাহরণ, যার মধ্যে ছিলেন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা, সরকারি কর্মকর্তা ও সংসদ সদস্যরাও।
কনজারভেটিভ পার্টির নেত্রী কেমি ব্যাডেনক বলেন, কেউ মারাত্মক ভুল করেছিলেন এবং নামগুলো প্রকাশ হয়েছিল, যা অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক।
২০২৪ সালের আদালতের রায়ে বিচারক চেম্বারলেইন মন্তব্য করেন, ফেসবুকে ফাঁস হওয়া তথ্য তালেবান অনুপ্রবেশকারীদের হাতে পড়েছিল কিংবা তারা এটি নিয়ে আলোচনা করেছে—এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
শুরুর দিকে ধারণা করা হয়েছিল, তালিকায় থাকা ব্যক্তি বা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের নাম প্রকাশ হওয়ায় প্রায় এক লাখ মানুষ ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। তবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, শুধুমাত্র ফাঁস হওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কাউকে লক্ষ্যবস্তু করা ‘খুব কম সম্ভাব্য’, এবং তথ্যটি ব্যাপকভাবে ছড়ায়নি।
ক্ষতিগ্রস্তদের সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে, যাতে তারা অনলাইনে গোপনীয়তা বজায় রাখেন এবং অপরিচিত বার্তার জবাব না দেন। হিলি জানিয়েছেন, যুক্তরাজ্যে স্থানান্তরিত আফগানরা অভিবাসন পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
এই সংকটের সূত্রপাত ২০২১ সালের আগস্টে, যখন মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর তালেবান কাবুল দখল করে। ফাঁস হওয়া নামের তালিকাটি ছিল আফগান রিলোকেশনস অ্যান্ড অ্যাসিস্ট্যান্স পলিসির (এআরএপি) আওতায় আবেদনকারীদের। তালেবানের প্রতিশোধের আশঙ্কায় অনেকেই এ কর্মসূচির আওতায় যুক্তরাজ্যে যেতে চেয়েছিলেন। তখন ৩৬,০০০ আফগানকে স্থানান্তর করা হয়। ২০২২ সালের এক সংসদীয় তদন্তে এই কার্যক্রমকে ব্যর্থতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা বলা হয়।
ফাঁসের ঘটনায় নতুন কর্মসূচি চালু হলেও যখন সাংবাদিকরা বিষয়টি অনুসন্ধান করতে শুরু করেন, সরকার আদালতের মাধ্যমে একটি সুপার-ইনজাংকশন নেয়, যা শুধু ফাঁসের তথ্য নয়, এই আদেশের অস্তিত্ব নিয়েও রিপোর্ট নিষিদ্ধ করে।
জন হিলি জানান, এমন কঠোর আদেশ আগে কখনও দেখেননি। ছায়া প্রতিরক্ষা সচিব থাকাকালেও তিনি বিষয়টি নিয়ে সংসদে মুখ খুলতে পারেননি।
বিচারক চেম্বারলেইন বলেন, এই সুপার-ইনজাংকশন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য উদ্বেগজনক এবং গণতান্ত্রিক জবাবদিহি প্রক্রিয়া ব্যাহত করেছে। তিনি একে ‘পর্যবেক্ষণ শূন্যতা’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
আদালতের নথি থেকে জানা যায়, তৎকালীন প্রতিরক্ষা সচিব বেন ওয়ালেস নিজেরাই এই নিষেধাজ্ঞার আবেদন করেন যাতে সরকার বিপদের মুখে থাকা ব্যক্তিদের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারে।
২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা বাড়ানো হলেও, বিচারক পরবর্তীতে সেটি তুলে নেন কারণ পর্যালোচনায় উঠে আসে, তালেবান ইতোমধ্যে ফাঁস হওয়া তথ্যের মূল অংশ জেনে ফেলতে পারে এবং নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখার প্রয়োজন নেই।
ছায়া প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জেমস কার্টলিজ বলেন, এই তথ্য কখনোই ফাঁস হওয়ার কথা ছিল না। তিনি এটিকে ‘ডেটা নিরাপত্তা লঙ্ঘনের একটি অগ্রহণযোগ্য দৃষ্টান্ত’ হিসেবে অভিহিত করেন।
আইনজীবী এরিন অলকক, যিনি শত শত এআরএপি আবেদনকারীকে সহায়তা করেছেন, এই ঘটনাকে একটি ‘বিপর্যয়কর ব্যর্থতা’ হিসেবে আখ্যা দেন।
সরকার জানায়, এ মাসের শুরুতে আরেকটি আলাদা তথ্য ফাঁসের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত আফগানদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।